পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

বালককালে তিনি এমন নির্জনতা-প্রিয়, নিঃসঙ্গ, একক-স্বভাবের হইয়াছিলেন। পাঁচ-ছয় বৎসরের বালককালের নিজের একটি সন্ধ্যাকালীন চিত্র তিনি এইভাবে অঙ্কিত করিয়াছেন দেখা যায়, “এই নিস্তব্ধ-প্রায় জগতের মধ্যে আমি ছিলুম এক কোণের মানুষ, লাজুক, নীরব, নিশ্চঞ্চল।”

 আর একটু, বড় হইয়া নিজের এই একই চিত্র তিনি আঁকিয়াছেন—“সে হচ্ছে একটি বালক, সে কুনো, সে একলা, সে একঘরে, তার খেলা নিজের মনে। ” নিজের বাল্যজীবনকে রবীন্দ্রনাথ এই কয়টি কথার মধ্যে ধরিয়া দিয়া গিয়াছেন,, “আমি ইস্কুল-পালানো ছেলে, পরীক্ষা দেইনি, পাস করিনি, মাষ্টার আমার ভাবীকালের সম্বন্ধে হতাশ্বাস। ইস্কুল ঘরের বাইরে যে অবকাশটা বাধাহীন, সেইখানে আমার মন হা-ঘরেদের মত বেরিয়ে পড়েছিল।”

 অন্তরগর্ভে যে ব্রহ্মবীজ তিনি জন্ম হইতেই ধারণ ও বহন করিতেছিলেন তাহারই প্রভাব তাঁহার বালককালের এই চরিত্রে ও স্বভাবে পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে। এইজন্যই কাহাকেও গাছের পাতা ছিঁড়িতে দেখিলে ছয়-সাত বৎসরের বালক রবীন্দ্রনাথ এমন মর্মবেদনা অনুভব করিতেন, এই কারণেই ছয়-সাত বৎসরের বালক বাড়ীর ছাদে উঠিয়া আকাশের দূর দিগন্তের দিকে চাহিয়া উদাসী ও আনমনা হইয়া যাইতেন।

 বীজমাত্রেরই পুষ্টি, পূর্ণতা এবং প্রকাশের জন্য অনুকূল ক্ষেত্রের প্রয়োজন। ঊষর মরুভূমিতে ভালো বীজও ব্যর্থ, আবার দুর্বল বীজও রসের জোরে কঠিন পাথর ঠেলিয়া আকাশের আলোকে ডালপালা মেলিয়া থাকে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ব্রহ্মবীজটি কিরূপে পরিবেশ বা প্রতিবেশ প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহার একটু সংবাদ লওয়া আবশ্যক।

 এগারো বারো বৎসরের পূর্বোক্ত ঘটনার কয়েকদিন পরেই বালক রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখিতে পাই হিমালয়ে, পিতা মহর্ষির সঙ্গে তিনি হিমালয়-ভ্রমণে আসিয়াছেন। ইহা রবীন্দ্রনাথের জীবনে আকস্মিক বা অর্থহীন ঘটনামাত্র নহে: যাঁহার ইঙ্গিতে সর্বকিছু নিয়ন্ত্রিত, তাঁহারই অদৃশ্য নির্দেশে এই সময়ে ঋষি বালকের এই হিমালয়ে আগমন। হিমালয় শিবভূমি, হিমালয় যোগভূমি এবং হিমালয় ভারতের মুনি-ঋষি-দেবতার অনন্তসঞ্চিত তপস্যার পাষাণঘন মূর্তি— ব্রহ্মবীজের পোষণ ও পূর্ণতার ইহাই শ্রেষ্ঠতম পরিবেশ। এই শিবভূমির অদৃশ্য মহাযোগীর হস্তধৃত কমণ্ডলুর জলে এই ব্রহ্মবীজের অভিষেক-স্নান আবশ্যক, তাই অদৃশ্যের আমোঘ আকর্ষণে রবীন্দ্রনাথের এখানে না আসিয়া উপায় ছিল না।