পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
১৯

যখন চুপ করে বসেছিলেন, তখন আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলুম।...... মনে হয় না আপনি আমাদের কেউ।”

 উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেন,

 “সত্যি কথাই বলব, আমি তোমাদের কেউ নই। ভিতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম, চিরদিন মনে মনে আমি উদাসী। তাই একদিন লিখেছিলুম— আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী। এ কিন্তু একটা কবিত্বের কথা মাত্র নয়। লোকে মনে করে, এটা কবির একটা মুডমাত্র। কিন্তু তা ঠিক নয়। এ আমার জীবনের একটা গভীরতম সত্য যে, আমি সুদূরের পিয়াসী।”

 এখানে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্বন্ধে বলিয়াছেন, “ভিতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম।”

 নির্মম মানে নিষ্ঠুর নয়, নির্মম মানে মমতাশূন্য, নিরাসক্ত ও বন্ধন শূন্য। ভিতরের সেই নির্মম নিরাসক্ত মনের নির্জন গুহায় তিনি সরিয়া গিয়াছিলেন বলিয়াই তাঁহাকে সেদিন এজগতের লোক বলিয়া মনে হয় নাই, অত্যন্ত অপরিচিত অতি-দূরের মানুষ মনে হইয়াছে।

 এখন আমাদের জিজ্ঞাস্য, মনের ঐ মুক্ত-ভিতরটিতে কি ইচ্ছা হইলেই যাওয়া যায়, না সকলেই যাইতে পারে? বহু সাধনায় ও অভ্যাসে মনের ঐ নিরাসক্ত ভূমি লব্ধ হইয়া থাকে। মনের ঐ ভূমিতে যাঁহার যাতায়াত আছে, অথবা মনের ঐ ভূমির যিনি বাসিন্দা, তিনিই বলিতে পারেন “আমি তোমাদের কেহ নই. আমি সুদূরের।”

 আত্মা যেমন দেহে থাকিয়াও দেহের অংশ নহে, সূর্যের আলো যেমন জগতের সর্বকিছুর উপর পড়িয়াও জগতের নহে, এই অবস্থানও তদ্রূপ। দেহে থাকিয়াও এই দেহাতীত বা বিদেহী স্থিতি সিদ্ধ সাধকেরই হইয়া থাকে। আর সাধনা ব্যতীত এ-সিদ্ধি আসে না। রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত চিত্র বা অবস্থা তাঁহার জীবনের আড়ালে সঙ্গোপনে গূঢ় এক সাধনারই সিদ্ধির পরিচায়ক বা চিহ্ন।