পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

 “যেন কী রকম একটা যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।”

 কাহার সঙ্গে কাহার যোগসূত্র ছিন্ন হইল? দেহের সঙ্গে দেহী বা দেহধারীর। এই যোগসূত্রটি কি, যাহা ছিন্ন হইয়াছে? দেহ বোধ বা দেহ চৈতন্যই সেই যোগসূত্র। এই বোধ কাহার থাকে না? যে মৃত, যে মূর্ছাতুর সংজ্ঞাহারা, যে গভীর সুষুপ্ত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ জাগ্রত ছিলেন, সজ্ঞানেই তিনি দেহ হইতে আলাদা হইয়াছিলেন।

 শাস্ত্রেও দেখা যায় যে, মহর্ষি অষ্টাবক্র রাজর্ষি জনককে বলিয়াছেন—

“যদি দেহ পৃথক কৃত্বা চিতি বিশ্রাম্য তিষ্ঠসি।
অধুনৈব সুখী শান্তো বন্ধমুক্ত ভবিষ্যসি॥”

 দেহ হইতে পৃথক হইয়া চিত্তে বিশ্রাম লাভ যে করিতে পারে, তাহারই পরম সুখ, শান্তি ও বন্ধনমুক্তি ঘটিয়া থাকে॥

 ইচ্ছা করিলেই কেহ কখনো নিজেকে নিজের দেহ হইতে পৃথক করিতে পারে না, এ শক্তি যোগসিদ্ধ পুরুষদের পক্ষেই সম্ভবপর। কিন্তু উল্লিখিত ঘটনায় দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিজ দেহ হইতে পৃথক করিবার কৌশল জানিতেন। এই কৌশলেরই নাম যোগ এবং এ যোগ কদাচ সাধনা ব্যতীত কাহারও আয়ত্তগত হয় না।

 আর একটি ঘটনারও উল্লেখ করা যাইতেছে; মৈত্রেয়ী দেবী ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’—গ্রন্থে ঘটনাটির বিশদ বিবরণ দিয়াছেন, রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন প্রায় আশি। ব্যাপারটি সংক্ষেপে এই—

 সন্ধ্যার পরে রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বাড়ীর সকলে সমবেত হইয়াছেন, স্বয়ং কবি একটির পর একটি নিজের কবিতা পাঠ করিয়া শুনাইতেছেন ব্যাখ্যা করিতেছেন, নিজের বহু গান একটির পর একটি গাহিয়া শুনাইতেছেন, ইহার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা-তামাসারও অজস্র পরিবেশন চলিয়াছে, আনন্দ ও তৃপ্তিরসে তিনি সকলের হৃদয়পাত্র সেদিন কানায় কানায় ভরিয়া তুলিয়াছিলেন।

 বহুক্ষণ হয় এই আনন্দ আসর ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, এক সময়ে গৃহকর্ত্রী (লেখিকা) ফিরিয়া আসিয়া দেখিতে পান যে, রবীন্দ্রনাথ একা চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। কিন্তু এ কোন্ রবীন্দ্রনাথ! ইনিই কি কিছু পূর্বে কবিতায় গানে হাস্যে উচ্ছ্বল হইয়া উঠিয়াছিলেন? একেবারে অপরিচিত এক রবীন্দ্রনাথ, ইনি যেন এ জগতের কেহ নহেন।

 কথাটা গৃহকর্ত্রী অতি সন্তর্পণে এবং সভয়ে রবীন্দ্রনাথকে বলেন,—“আপনি