পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
৩১

 উপনিষদ বলিয়াছেন, এই দেখার পরে ‘তখন সে (জীব) শোকের অতীত হয়’, আর রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন—“নিজের অস্তিত্বের ভার লাঘব হয়ে গেল।... একটা মুক্তির আনন্দ পেলুম”।

 অধিক বিশ্লেষণ আর আবশ্যক করে না, এখন বলা চলে যে, এই উপলব্ধিটিই সন্দেহাতীত প্রমাণ যে, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ, রবীন্দ্রনাথ ঋষি। আপনার মধ্যে নিজেকে এবং ব্রহ্মকে তিনি দেখিয়াছেন, আর দেখিয়াছেন—জগৎ ব্রহ্মেরই আনন্দলীলা।

 এত বড় প্রাপ্তি এবং এত বড় মুক্তির প্রথম প্রকাশটি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে একটি আনন্দ-প্রণামের রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। তাই তাঁহার উপলব্ধিটির বিবরণের উপসংহারে আসিয়া পাওয়া যায় —

 “একটা মুক্তির আনন্দ পেলুম। চোখ দিয়ে জল পড়চে তখন, ইচ্ছে করচে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন ক’রে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করি কাউকে। কে সেই আমার পরম অন্তরঙ্গ সাক্ষী।”

 ইহাই রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম-প্রণাম। যাঁহাকে তিনি প্রণাম করিয়াছেন, যাঁহার নিকট সম্পূর্ণভাবে তিনি আত্মনিবেদন করিয়াছেন, তিনি যে ব্রহ্ম, সে কথা রবীন্দ্রনাথ গোপন করিতে পারেন নাই, তাঁহার উপলব্ধির শেষ কয়টি কথাতেই তাহা ব্যক্ত—

 “তখনি মনে হ’ল আমার একদিক থেকে বেরিয়ে এসে আর একদিকের পরিচয় পাওয়া গেল। এষোঽস্য পরম আনন্দঃ, আমার মধ্যে এ এবং সে—এই এ যখন সেই সে-র দিকে এসে দাঁড়ায় তখন তার আনন্দঃ।”

 উপনিষদের একই বৃক্ষের দুই পক্ষীকে এখানে রবীন্দ্রনাথ এ এবং সে বলিয়াছেন দেখা যায়। আর সেই সে-ই এই এ-র পরম আনন্দ, ইহাই তিনি প্রত্যক্ষকরিয়াছেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখা যায় যে, মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য শিষ্য জনককে ব্রহ্মের উপনীত করিয়া ঠিক এই কথাই বলিয়াছেন—

 হে সম্রাট, “এষাঽস্য পরমা গতিঃ এষাহস্য পরমা সম্পদেষাহস্য পরমো লোক এষোহস্য পরম আনন্দ এতস্যৈবানন্দস্যান্যানি ভূতানি মাত্রামুপজীবন্তি” — হে সম্রাট, ইনিই জীবের পরমা গতি, ইনিই জীবের পরম সম্পদ, ইনিই জীবের পরম ধাম, ইনিই জীবের পরম আনন্দ। এই আনন্দেরই অংশমাত্র অবলম্বনে সমস্ত প্রাণী ও ভূতজগৎ জীবন ধারণ করে ॥

 এক কথায়, জীবের মক্তি, পরিপূর্ণতা, আনন্দ, অমৃত ইত্যাদি সমস্তই এই ব্রহ্মের মধ্যে এবং সেই ব্রহ্ম এই দেহেই জীব-সখারূপে অবস্থিত। ইহাকেই পরম অন্তরঙ্গ সঙ্গী, নিত্যসাক্ষী, পরমদ্রষ্টা, সর্বানুভূঃ প্রভৃতি নামে ডাকিয়া আত্ম-