বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৮
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

 —এই ব্রহ্ম সর্বভূতের মধ্যে গূঢ় অনুপ্রবিষ্ট, তিনি প্রকাশিত নহেন; সূক্ষ্মদর্শিগণই সূক্ষ্ম একাগ্র বুদ্ধির সাহায্যে তাঁহাকে দেখিতে পান॥

 উদ্ধৃত শ্রুতিসমূহে দেখা যায় যে, উপনিষদ যেখানেই ব্রহ্মদর্শনের কথা বলিয়াছেন, সেখানেই ধ্যানযোগ, অধ্যাত্মযোগ, নিদিধ্যাসন ইত্যাদির উপদেশ করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের আলোচ্য উপলব্ধিতেও এই কথাই আমরা দেখিতে পাই, তিনিও বলিয়াছেন—“ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে।”

 কাজেই ধ্যানচোখ বা ধ্যানদৃষ্টির সামান্য একটু বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সেই বিশ্লেষণেই দেখা যাইবে যে, ধ্যানচক্ষু বা ধ্যানদৃষ্টির পশ্চাতে কি এবং কতখানি পূর্বসাধনা নিহিত থাকে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে ব্যক্তিগত সাধনা সম্বন্ধে একটা ধারণা করিতে হইলে এই বিশ্লেষণটুকুকে পাশ কাটাইয়া যাইবার উপায় নাই।

 ধ্যান শব্দটি যোগের একটি বিশেষ পরিভাষা। কৌতূহলী পাঠক মহর্ষি পতঞ্জলির ‘যোগসূত্র’ পাঠ করিলে এই বিষয়ে বিস্তৃতভাবে জানিতে পারিবেন। বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ বা প্রয়োজন বর্তমান ক্ষেত্রে নাই।

 সংক্ষেপে শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট যে, যোগ বলিতে সমাধিকে বুঝাইয়া থাকে;আর ধ্যানেরই প্রগাঢ় অবস্থার নাম সমাধি। ধ্যানসিদ্ধ পুরুষই সমাধিবান পুরুষ।

 সহজ করিয়া বলা যাইতে পারে যে, ইচ্ছামাত্র যাঁহার মন ও ইন্দ্রিয়সমুদয় বিষয় হইতে প্রত্যাহৃত হয়, ইচ্ছামাত্র মন যাঁহার একাগ্র বা নিরুদ্ধ হয়, তিনিই প্রকৃত ধ্যানীপুরুষ। এই পুরুষেরই মনের একাগ্র বা নিরুদ্ধভূমিতে যে-দৃষ্টি থাকে, তাহারই নাম ধ্যানচক্ষু বা ধ্যানদৃষ্টি।

 চিত্তের একাগ্রতা বা চিত্তের নিরোধশক্তি দীর্ঘ সাধনা ও অভ্যাসের পরেই ক্রমে ক্রমে লব্ধ হয়। তাহার পরেই এই ধ্যানদৃষ্টি বা ধ্যানচক্ষু সিদ্ধসাধকের স্বভাবে বা স্বাভাবিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়। দেহ-মন-বুদ্ধির বহু বাধা, বিঘ্ন, ক্লেশ ইত্যাদি দীর্ঘ সাধনায় পার হইয়া তবে ধ্যানভূমিতে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভবপর হইয়া থাকে। সেই ভূমির পুরুষেরই স্বাভাবিক অথচ বিশেষ দৃষ্টির নাম ধ্যানচক্ষু। মনের সেই একাগ্র বা নিরুদ্ধ ভূমিতে যিনি চক্ষু মেলিতে পারেন, তাঁহার দৃষ্টিতেই ব্রহ্ম প্রকাশিত হন।

 সাধারণের বোধগম্য করিয়া এককথায় বলা চলে যে, ইচ্ছামাত্র যে পুরুষ নিজের ভিতরকার সুষুপ্তি অবস্থাটিতে পৌঁছিতে পারেন এবং সেই গভীর ও প্রগাঢ় নিদ্রার মধ্যেও আপন চেতনাকে জাগ্রত অবস্থার ন্যায় সজাগ রাখিতে পারেন, তিনিই