পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
৫৫

 রবীন্দ্রনাথ যাহাকে ‘দীপ্তিময়ী শিখা’ বলিয়াছেন, তাহা ব্রহ্মজ্যোতি, ‘যোগিযাজ্ঞবল্ক্য’-গ্রন্থে এই সিদ্ধান্তের সমর্থন ও অনুমোদন পাওয়া যায়। যথা—

 অত্রি ঋষি মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করিয়াছেন, “এই যে অনন্ত অব্যক্ত আত্মা, তাঁহাকে কেমনি জানিব?”

 উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বলিয়াছেন, “এষোহনন্তোব্যক্ত আত্মা অবিমুক্তে প্রতিষ্ঠিত।”

 সেই ‘অবিমুক্ত’ কোথায়?

 উত্তরে মহর্ষি বলেন, “ভবোর্ঘ্রাণস্য যঃ সন্ধিঃ- ভ্রূ, এবং নাসিকার সন্ধিস্থানই অবিমুক্ত॥”

 এই স্থানেরই নাম আজ্ঞাচক্র এবং এই আজ্ঞাচক্রেই পূর্বোক্ত 'ভারূপমমৃতং—জ্যোতির্ময় অমৃতস্বরূপকে, ‘জ্ঞানময়ী দীপবদুজ্জ্বলা প্রভা’-কে দর্শন করিবার উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে। কাজেই, মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য আজ্ঞাচক্রে ব্রহ্মজ্যোতি বা আত্মজ্যোতি দর্শনের উপদেশই দিয়াছেন, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকিতে পারে না।

 রবীন্দ্রনাথের দৃষ্ট ‘দীপ্তিময়ী শিখা’ আর এই আজ্ঞাচক্রের আত্মজ্যোতি যদি এক হয়, তবে রবীন্দ্রনাথের দর্শনকে ব্রহ্মদর্শন বলিয়া স্বীকার না করিবার কোন কারণ থাকিতে পারে না।

 ধ্যানবিন্দু উপনিষদেও একটি মন্ত্র আছে——

 “ভ্রূদ্বয়ের মধ্যে ললাটের যে একদেশস্থান তাহাই অমৃতস্থান (ব্রহ্মস্থান)। ঐ স্থানই বিশ্বের মহান আধারস্বরূপ—অমৃতস্থানং বিজানীয়াদ্বিস্যাযতনং মহৎ॥” অর্থাৎ, এই স্থান বা এই জ্যোতি, অথবা এই লোক বা আলোক-ই বিশ্বের সৃষ্টি–স্থিতি-প্রলয়ের আশ্রয়। আর ব্রহ্মই যে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের একমাত্র আশ্রয়, ইহাই সর্বোপনিষদের উপদেশ।

 প্রসঙ্গত উল্লেখ থাকে যে, এখানে যে স্থানকে ‘অমৃতস্থান’ এবং ‘বিশ্বস্যায়তনং মহৎ’ বলা হইয়াছে, প্রসিদ্ধ মাণ্ডুক্য উপনিষদে ‘সুষুপ্তিস্থান’ সম্বন্ধেই সেই উপদেশ পাওয়া যায়,—

 “সুষুপ্তিস্থানই (সুষুপ্তি যাঁহার স্থান)....প্রভবাপ্যয়ৌ হি ভূতানাম— স্থূল ও সূক্ষ্ম ভূতবর্গের উৎপত্তি ও প্রলয়স্থান॥”

 কাজেই এখন বলা যাইতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্ট ‘দীপ্তিময়ী শিখা’, যাজ্ঞবল্ক্যের উপদিষ্ট ‘জ্ঞানময়ীপ্রভা’ এবং মাণ্ডুক্য উপনিষদের সুষুপ্তি-স্থানপুরুষ একই সত্যের বা তত্ত্বের ইঙ্গিত করিয়া থাকে।