বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৬
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

 ব্যাখ্যা হইতে আমরা বিরত থাকিতে পারি। এ-পত্র লেখার কয়েক বৎসর পরে শান্তিনিকেতনের এক উপাসনা-ভাষণে রবীন্দ্রনাথ এই ‘অন্তরিন্দ্রিয়ের’ কথা উল্লেখ করিয়াছেন দেখা যায়। সেইটুকু উদ্ধৃত করিলেই আমাদের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাইবে। সে উপাসনা-ভাষণে তিনি বলিয়াছেন—

 “উপনিষৎ তাঁকে বলেছেন: গুহাহিতং গহ্বরেষ্ঠং। অর্থাৎ, তিনি গুপ্ত, তিনি গভীর। তাঁকে শুধু বাইরে দেখা যায় না—তিনি লুকানো আছেন; বাইরে যা-কিছু প্রকাশিত তাকে জানবার জন্যে আমাদের ইন্দ্রিয় আছে—তেমনি যা গূঢ়, যা গভীর, তাকে উপলব্ধি করবার জন্যেই আমাদের গভীরতর অন্তরিন্দ্রিয় আছে॥”

 তাঁহার চিঠিতে যে ‘নিগূঢ় চেতনা একটা নূতন অন্তরিন্দ্রিয়’-এর কথা রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন, এই ‘গুহাহিতং গহ্বরেষ্ঠং’ যে-ব্রহ্ম, তাঁহাকেই দর্শনই ইহার কাজ। রবীন্দ্রনাথের ‘অন্তরিন্দ্রিয়’ তাঁহার দর্শন পাইয়াছে কিনা, চিঠিতেই সে প্রশ্নের জবাব আছে যেখানে তিনি বলিয়াছেন— ‘বেশ বুঝতে পারছি, আমি আপনার মধ্যে আপনার একটা সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পারব, জীবনটাকে একটা সমগ্রতা দিতে পারব।’

 পূর্ণকে দেখিলেই তবে ‘জীবনের সমগ্রতা’ বা পূর্ণতা দান সম্ভবপর হয়। তাহার পূর্বে সমগ্রতা বা পূর্ণতার কোন আভাস মাত্রও জীবনে কাহারও আসে না, পূর্ণতা বা সমগ্রতা দানের আশা জীবনে দেখা দেওয়ার কথা তো উঠেই না।

 ৬৫ বৎসরে পদার্পণ করিয়া একখানি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্বন্ধে লিখিয়াছেন—

 “আজ বাইরে বসে খেলার চেয়ে খেলনার সাথীকেই বেশী দেখতে পাচ্ছি।... যাকে প্রবীণেরা মায়া বলে বর্ণনা করে সেই অনিত্যের খেলাঘরে সে কোন্ আশ্চর্যকে দেখতে পেল? যাঁকে দেখেছিল পূর্বদিগন্তে ঊষার প্রদোষ আলোয়, তাঁকেই দেখল পশ্চিম সিংহদ্বারে তারার প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত। যেতে যেতে বলতে পারব, দেখেছি॥”

 ‘অনিত্যের খেলাঘরে’ কে সে আশ্চর্য, যাঁহাকে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়াছেন? উপনিষদ যাঁহাকে বলিয়াছেন ‘নিত্যহ নিত্যানাং’ এই সমস্ত অনিত্যের যিনি নিত্য আশ্রয় বা এই সমস্ত অনিত্যের মধ্যে যিনি নিত্য, তাঁহাকেই ‘আশ্চর্য’ বলিয়া উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ করিয়াছেন এবং তাঁহাকে তিনি দেখিয়াছেন, এই কথাই তিনি জানাইতে চাহিয়াছেন।