পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
৮৭

লেখনী চালনা করিয়াছেন? তাহা নহে। সেই সঙ্গে ইহাও দেখিয়াছি যে, জীবনটা যে গঠিত হইয়া উঠিতেছে, তাহার সমস্ত সুখদুঃখ, তাহার সমস্ত যোগবিয়োগের বিচ্ছিন্নতাকে কে একজন একটি অখন্ড তাৎপর্যের মধ্যে গাঁথিয়া তুলিতেছেন॥”

 নিজের কাব্যসৃষ্টি সম্বন্ধে বলিতে গিয়া রবীন্দ্রনাথ এখানে যে উক্তিটি করিয়াছেন, তাহার মধ্যে এই প্রমাণও প্রসঙ্গত রহিয়াছে যে, তিনি ব্রহ্মজ্ঞ—যেখানে তিনি বলিয়াছেন ‘সেই সঙ্গে ইহাও দেখিয়াছি ইত্যাদি।’


 তাঁহার সাহিত্য-সাধনায় রবীন্দ্রনাথ কি মন্ত্রটি উদ্‌যাপন করিতে চাহিয়াছেন, এখন তাহা উল্লেখ করা যাইতেছে। সত্তর বৎসর বয়সের পূর্বোক্ত ‘প্রতি ভাষণে’ তিনি বলিয়াছেন—

 “ঈশোপনিষদের সেই মন্ত্রটি (ঈশাবাস্যামিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ। তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যসিদ্ধনম্॥—ব্রহ্মান্ডে যাহা কিছু অনিত্য বস্তু আছে, এই সমস্তই ঈশ্বরের দ্বারা বাসিত বা আচ্ছাদিত ইত্যাদি) বারবার নতুন নতুন অর্থ নিয়ে আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে, বারবার নিজেকে বলেছি—তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ মা গৃধঃ; আনন্দ করো তাই নিয়ে যা তোমার কাছে সহজে এসেছে, যা রয়েছে তোমার চারিদিকে, তারই মধ্যে চিরন্তন, লোভ করো না। কাব্যসাধনায় এই মন্ত্র মহামল্য।”

 কাব্য সাধনায় এই মহামন্ত্রের সাধনাই—ব্রহ্মসাধনা।

 ঈশোপনিষদের যে মন্ত্রটি রবীন্দ্রনাথ তাঁহার সাহিত্য-সাধনায় লক্ষ্য বা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন, তাহা উপনিষদের একটি মহাবাণী। ছান্দেগ্যোউপনিষদের ‘তত্ত্বমসি’—তুমিই ব্রহ্ম, এই মহাবাণীর ন্যায় ‘ঈশাবাস্য সর্বমিদং’ বাণীটিও অন্যতম মহা উপদেশ বলিয়া সাধক ও সিদ্ধসমাজে গৃহীত হইয়া থাকে। উপনিষদের ভাষ্যকারগণও ‘ঈশাবাস্যমিদং সর্বং’—এই জগতের সর্ববস্তুতে তিনি আছেন বা সর্ব কিছু ঈশ্বর দ্বারা আবরণীয় ও আচ্ছাদনীয় এই ব্রহ্মমন্ত্রটিকে বেদের অন্যতম ‘মহাবাণী’ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন।

 এই একটি বাণীর মধ্যেই অতীতের তপোবনের ব্রহ্মতত্ত্ব এবং ব্রহ্মসাধনা যুক্তভাবে সুগুপ্ত রহিয়াছে, সাধকসমাজে এই সত্য স্বীকৃত। ব্রহ্মসাধনার সেই মহা-উপদেশই রবীন্দ্রনাথ তাঁহার সমগ্র সাহিত্য সাধনায় উদ্‌যাপন করিয়াছেন এবং তাঁহার সাহিত্য সৃষ্টি সেই সাধনারই সাক্ষ্য—ইহাই রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব অভিমত।

 কাজেই আমরা প্রারম্ভেই বলিতে সাহস পাইয়াছি যে, ‘রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ