পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৮
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

পুরুষ’, এই সত্য প্রমাণের জন্য তাঁহার রচনাবলীকে সন্দেহাতীত সাক্ষ্য বা প্রমাণরূপে গ্রহণ করা আদৌ অযৌক্তিক নহে। দার্শনিকগণ রবীন্দ্র রচনায় এক দার্শনিক রবীন্দ্রনাথকে দেখিতে পাইয়াছেন, কিন্তু রবীন্দ্ররচনাবলীতে দার্শনিককে নহে এক দ্রষ্টা ও ঋষিকেই পাওয়া যায়—ইহা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তাঁহার আপন জীবনবৃত্তান্তে বলিয়া গিয়াছেন, আমরা দেখিয়াছি।

 কাজেই আমাদের আলোচ্য প্রশ্নের বিচারে আমরা যদি রবীন্দ্ররচনাবলীর আশ্রয় বা সাহায্য গ্রহণ করি, তবে তাহা যুক্তিযুক্ত ও সঙ্গত কাজই হইবে। তাহা না করিলেই বরং এ আলোচনা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ থাকিয়া যাইবে।

 কিন্তু রবীন্দ্ররচনাবলী এত বিশাল যে, তাহা হইতে আলোচ্য বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ করিতে গেলে বিস্তর সময়ের প্রয়োজন এবং কয়েক খন্ড গ্রন্থেও সে-আলোচনা শেষ করা যাইবে না। কাজেই, রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী হইতে কোন সাক্ষ্য প্রমাণাদি বক্ষ্যমান ক্ষেত্রে গৃহীত হইবে না, শুধু ‘গীতাঞ্জলি’ রচনাটিকে বিচারক্ষেত্রে কিছুক্ষণের জন্য উপস্থাপিত করা হইবে।

 সমগ্র রবীন্দ্ররচনাবলী হইতে একমাত্র ‘গীতাঞ্জলি’-কে গ্রহণ করার বিশেষ কারণ রহিয়াছে। ‘গীতাঞ্জলি’ নিছক কবিতা বা কাব্য নহে। তাহা হইলেও ‘রবীন্দ্ররচনাবলী’ হিসাবেই এই আসরে ইহার প্রবেশ অধিকার থাকিত, পূর্বেই সে আলোচনা আমরা করিয়াছি।

 ‘গীতাঞ্জলি’ রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত উপলব্ধিরই কাব্যময় প্রকাশ বা রূপ বলিয়া আমরা মনে করি। ‘গীতাঞ্জলি’ কবি রবীন্দ্রনাথের রচনা নহে, ইহা সাধকের রচনা, যেমন রামপ্রসাদের গান, যেমন কবীর, দাদু প্রমুখদের দোঁহা। ‘গীতাঞ্জলি’ ঋষি কবির ভজন, তাঁহার সাধন-সঙ্গীত, তাঁহার ব্রহ্মোপাসনা।

 কাজেই নিছক কাব্য সৃষ্টি ইহাকে বলা ভুল, ইহা রবীন্দ্রনাথের ভগবদ উপলব্ধির সাম-গান। গীতার বক্তার ন্যায় গীতাঞ্জলির কবিও বলিতে পারেন—“গীতাঞ্জলি মে হৃদয়ং সুধী, গীতাঞ্জলি মে সারমুত্তমম।”

 যে কারণে গীতাঞ্জলিকে রবীন্দ্ররচনাবলী হইতে স্বতন্ত্র এবং বিশেষ করা হইল, তাহা রবীন্দ্রনাথেরও স্বীকৃত ও অভিপ্রেত। একখানি চিঠিতে গীতাঞ্জলি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই অভিমতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। চিঠিখানি যখন তিনি লেখেন, তখনও ‘গীতাঞ্জলি’ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত হয় নাই। চিঠিখানির তারিখ ৬ই মে, ১৯১৩; আর ১৯১৩ সালের ১৩ই নভেম্বর তাঁহার নোবেল পুরস্কার সংবাদ এদেশে আসে।