পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/২৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চরকা
২৫৫

দিয়ে ছােটো ছােটো কুণ্ডে হাতের কাছে দিনের কাজ চালাবার মতাে জল ধরে রাখা যায়। এ দিকে বাঁধ ভেঙেছে যে! বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে দেনাপাওনা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকি এমন দিন আর নেই, কখনাে আসবেও না। তা ছাড়া সেরকম অবরােধই সব চেয়ে বড়াে দৈন্য। এমন অবস্থায় বিশ্বের সঙ্গে ব্যাপারের যােগ্য মনের শক্তি যদি না জাগাতে পারি,তা হলে ফসল খেয়ে যাবে অন্যে, তুঁষ পড়ে থাকবে আমাদের ভাগে। ছেলেভােলানাে ছড়ায় বাংলাদেশে শিশুদেরই লােভ দেখানাে হয় যে, হাত ঘুরােলে লাড়ু পাবার আশা আছে। কিন্তু, কেবল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাত চালানাের দ্বারা মনের নিশ্চলতার অভাব পূর্ণ হয়ে দৈন্য দূর হবে, স্বরাজ মিলবে, এমন কথা বয়ঃপ্রাপ্ত লােকদের বলা চলে না। বাইরের দারিদ্র্য যদি তাড়াতে চাই তা হলে অন্তরেই শক্তি জাগাতে হবে বুদ্ধির মধ্যে, জ্ঞানের মধ্যে, সহযােগিতা-প্রবর্তক হৃদ্যতার মধ্যে।

 তর্ক উঠবে, কাজ বাইরের থেকেও মনকে তাে নাড়া দেয়। দেয় বটে, কাজের মধ্যেই যদি মনের অভিমুখে কোনাে একটা চিন্তার ব্যঞ্জনা থাকে। কেরানির কাজে এটা থাকে না, এ কথা আমাদের কেরানিগিরি দেশে সকলেই জানে। সংকীর্ণ অভ্যাসের কাজে বাহ্য নৈপুণ্যই বাড়ে, আর বদ্ধ মন ঘানির অন্ধ বলদের মতাে অভ্যাসের চক্র প্রদক্ষিণ করতে থাকে। এইজন্যেই, যে-সব কাজ মুখ্যত কোনাে-একটা বিশেষ শারীরিক প্রক্রিয়ার পুনঃপুনঃ আবৃত্তি, সকল দেশেই মানুষ তাকে অবজ্ঞা করেছে। কার্লাইল খুব চড়া গলায় dignity of labour প্রচার করেছেন; কিন্তু বিশ্বের মানুষ যুগে যুগে তার চেয়ে অনেক-বেশি চড়া গলায় indignity of labour সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিয়ে আসছে। যারা মজুরি করে তারা নিতান্ত দায়ে পড়েই সমাজের বা প্রভুর, প্রবলের বা বুদ্ধিমানের, লােভে বা শাসনে নিজেদের যন্ত্র বানিয়ে তােলে। তাদেরই মন্ত্র: সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ। অর্থাৎ, না খেয়ে যখন মরতেই বসেছে তখন মনটাকে বাদ