পাতা:কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৮).pdf/৪০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪০০
কালান্তর

বিসর্জন করছে, সৃষ্টি করছে তারাই। এই ছিন্নবিচ্ছিন্ন অপমানিত জাতিরাই নূতন যুগকে রচনা করছে। প্রতাপশালী ভীরুরা তাদের ঐশ্বর্যভারে নত; পাছে কোনো জায়গায় তাদের কোনো ক্ষতি হয় এইজন্য তারা দুর্বলের পক্ষে দাঁড়াল না। তবু হতাশ হব না। যারা পীড়িত হচ্ছে মৃত্যুকে বরণ করেই তারা নূতনকে সৃষ্টি করছে; যারা দুঃখ পেল তারাই ধন্য। যারা দস্যুবৃত্তি করছে, যারা মানুষের পথ আগলে আছে, মানুষের ইতিহাসে তারা সম্মানের যোগ্য নয়। এ আশা দুরাশা নয়— বিনাশের শক্তিই মানুষের ইতিহাসে শেষ কথা হতে পারে না, তা হলে মানুষ বাঁচত না। অনেক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে এসেছে মানুষ, তবু তার বড়ো বড়ো কামনা মরে নি। কেবল ক্ষুধাতৃষ্ণার দাস নয় সে, এখনো মানুষ চলেছে; এখনো তার মহত্ত্বের উৎস শুকোয় নি। মানুষের ইতিহাসের অন্তরে যদি মহতের কোনো স্থান না থাকত তবে মানুষের ইতিহাস এত অত্যাচার সহ্য করেও প্রাণশীল থাকত না। আজকের দিনে এই গভীর নৈরাশ্যের মধ্যে এইই মানুষের আশ্বাসবাণী। সমস্ত সংঘাতের মধ্যেও কল্যাণের রূপ প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে— সমস্ত দুঃখের মধ্যে সমস্ত পাপের মধ্যে পুণ্যের আবির্ভাব এই আমাদের আশা।

 চীনের প্রতি নিষ্ঠুর অত্যাচারে আজ আমাদের হৃদয় উৎপীড়িত কিন্তু, আমাদের কী করবার আছে? আমরা কী করতে পারি? আমরা অত্যাচারীকে নিন্দা করছি কিন্তু বলা যেতে পারে, নিন্দা করে কী লাভ? এই দুঃখবোধ-দ্বারা, দানবের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করে আমরাও সেই সৃষ্টির পক্ষে কাজ করছি— এর শক্তি যতই ক্ষীণ হোক এও সৃষ্টির কাজ। আমাদের অস্ত্র নেই, কিন্তু আমাদের মন আছে। আমরা লড়াই না করতে পারি, কিন্তু এ কথা যদি আমাদের মনে জাগ্রত রাখি যে অধর্মের দ্বারা আপাতত যতই উন্নতি হোক তার মূলে আছে বিনাশ— যদি এ কথা বিস্মৃত না হই যে মানব-ইতিহাসের মূলে কল্যাণের শক্তি কাজ করছে—