বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:ক্রৌঞ্চ-মিথুনের মিলন-সেতু - অনুরূপা দেবী.pdf/৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ক্রৌঞ্চ-মিথুনের মিলন-সেতু
৬৮

বিশ্বাস করে নাই। যারা এতদিন তার মুখর কলহপরায়ণতায় তাকে নিন্দা-বিদ্বেষ করিয়া আসিয়াছিল, তারাই স্তম্ভিতচিত্তে তার প্রশংসা না করিয়া পারিল না। পরাণকে খুনে বলিয়া সকলেই মনে মনে শিহরিয়া রহিল। তার মুক্তি তারা বেশ মনের সঙ্গে পছন্দ করিতে পারিল না। স-সর্প গৃহে বাস করার মতই এই হত্যাকারীকে নিজেদের ভিতর রাখা একটুও নিরাপদ নয়, এ-কথা প্রত্যেকেই পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করিল, কিন্তু প্রকাশ্যে বিরোধিতা করিবার মত সাহস কেহই সঞ্চয় করিতে পারিল না। দক্ষিণধারের প্রতিবেশীই এ ঘটনায় সবিশেষ আশাহত হইলেন, দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া আত্মগতই তিনি বলিলেন, “হরি হে দীনবন্ধু! তুমিও শেষকালে তোমার নাম ডোবালে? কলিকালে পাপীরই বন্ধু হলে? তা’ হও, কি করবে, তোমার আর দোষ কি? যুগের হাওয়া।”

 কিন্তু বেশীদিন নয়, পরাণ শীঘ্রই ইহাদের মুক্তি দিল। সেও আর এ ঘটনার পরে তার চিরপরিচিতদের মধ্যে তিষ্ঠিতে পারিতেছিল না। সে সুস্পষ্টরূপেই বুঝিতে পারিতেছিল যে, তার আজীবনের পরিচিতরা তাকে আর ঠিক স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখিতে পারিতেছে না। এই কয়টা দিন হাজত বাস করিয়া আসিয়াই সে যেন তাদের আগেকার চিরপরিচিত সেই পরাণ কৈবর্ত্ত আর নয়—একজন ঘোর অপরিচিত ব্যক্তি, যার সমস্তটাই রহস্যময় কঠিন আবরণের মধ্যে সকলের পক্ষে দুষ্প্রবেশ্য হইয়া আছে। তার প্রতি পদক্ষেপে লোকে পিছনে হটিয়া যায়, গলার স্বর শুনিলে মানুষ চমকিয়া নীরব হইয়া পড়ে, মুখের হাসি সন্দেহের ছায়ায় আত্মগোপন করে। প্রতি মুহূর্ত্তে, প্রত্যেক লোকের প্রতিটি ব্যবহারে অব্যক্ত ভাষায় তার স্বরে ধ্বনিত হইতে থাকে, “আইনের চোখে পার পেয়ে এলেও—ও খুনী ও—খুনী! নাঃ, জয়দুর্গা প্রতিশোধ লইয়াছে বটে!”