পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গুপ্তধন
৫৪৭

মত্যুঞ্জয় যখন শিশু ছিল, যখন তাহার পিতামহ হরিহর একদিন এই চণ্ডীমণ্ডপে, বসিয়া তামাক খাইতেছিল, তখন এমনি করিয়াই একটি সন্ন্যাসী ‘জয় হােক বাবা’ বলিয়া এই প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। হরিহর সেই সন্ন্যাসীকে কয়েকদিন বাড়িতে রাখিয়া বিধিমতাে সেবার দ্বারা সন্তুষ্ট করিল।

 বিদায়কালে সন্ন্যাসী যখন জিজ্ঞাসা করিলেন “বৎস, তুমি কী চাও”, হরিহর কহিল, “বাবা, যদি সন্তুষ্ট হইয়া থাকেন তবে আমার অবস্থাটা একবার শুনুন। এক কালে এই গ্রামে আমরা সকলের চেয়ে বর্ধিষ্ণু ছিলাম। আমার প্রপিতামহ দূর হইতে কুলীন আনাইয়া তাঁহার এক কন্যার বিবাহ দিয়াছিলেন। তাঁহার সেই দৌহিত্রবংশ আমাদিগকেই ফাঁকি দিয়া আজকাল এই গ্রামে বড়ােলােক হইয়া উঠিয়াছে। আমাদের এখন অবস্থা ভালাে নয়, কাজেই ইহাদের অহংকার সহ্য করিয়া থাকি। কিন্তু, আর সহ্য হয় না। কী করিলে আবার আমাদের বংশ বড়াে হইয়া উঠিবে সেই উপায় বলিয়া দিন, সেই আশীর্বাদ করুন।”

 সন্ন্যাসী ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “বাবা, ছোটো হইয়া সুখে থাকো। বড়াে হইবার চেষ্টায় শ্রেয় দেখি না।”

 কিন্তু, হরিহর তবু ছাড়িল না, বংশকে বড়াে করিবার জন্য সে সমস্ত স্বীকার করিতে রাজি আছে।

 তখন সন্ন্যাসী তাঁহার ঝুলি হইতে কাপড়ে-মােড়া একটি তুলট কাগজের লিখন বাহির করিলেন। কাগজখানি দীর্ঘ, কোষ্ঠীপত্রের মতাে গুটানাে। সন্ন্যাসী সেটি মেজের উপরে খুলিয়া ধরিলেন। হরিহর দেখিল, তাহাতে নানাপ্রকার চক্রে নানা সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা, আর, সকলের নিম্নে একটি প্রকাণ্ড ছড়া লেখা আছে তাহার আরম্ভটা এইরূপ—

পায়ে ধরে সাধা।
রা নাহি দেয় রাধা।
শেষে দিল রা,
পাগােল ছাড়ো পা।
তেঁতুল বটের কোলে
দক্ষিণে যাও চলে।
ঈশানকোণে ঈশানী,
কহে দিলাম নিশানী। ইত্যাদি।

 হরিহর কহিল, “বাবা, কিছুই তাে বুঝিলাম না।”

 সন্ন্যাসী কহিলেন, “কাছে রাখিয়া দাও, দেবীর পূজা করাে। তাঁহার প্রসাদে তােমার বংশে কেহ না কেহ এই লিখন বুঝিতে পারিবে। তখন সে এমন ঐশ্বর্য পাইবে জগতে যাহার তুলনা নাই।”

 হরিহর মিনতি করিয়া কহিল, “বাবা কি বুঝাইয়া দিবেন না।”

 সন্ন্যাসী কহিলেন, “না। সাধনা দ্বারা বুঝিতে হইবে।”

 এমন সময় হরিহরের ছােটো ভাই শংকর আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া হরিহর তাড়াতাড়ি লিখনটি লুকাইবার চেষ্টা করিল। সন্ন্যাসী হাসিয়া কহিলেন,