পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ১২৯ জয়পরাজয় রাজকন্যার নাম অপরাজিতা। উদয়নারায়ণের সভাকবি শেখর তাঁহাকে কখনও চক্ষেও দেখেন নাই। কিন্তু যে দিন কোনো নতন কাব্য রচনা করিয়া সভাতলে বসিয়া রাজাকে শনাইতেন সে দিন কণ্ঠস্বর ঠিক এতটা উচ্চ করিয়া পড়িতেন যাহাতে তাহা সেই সমক্ষে গহের উপরিতলের বাতায়নবতিনী অদশ্য শ্রোত্রীগণের কশপথে প্রবেশ করিতে পারে। যেন তিনি কোনো-এক অগম্য নক্ষত্ৰলোকের উদ্দেশে আপনার সংগীতোছাস প্রেরণ করিতেন যেখানে জ্যোতি কমণ্ডলীর মধ্যে তাঁহার জীবনের একটি অপরিচিত শুভগ্রহ অদশ্য মহিমায় বিরাজ করিতেছেন। কখনো ছায়ার মতন দেখিতে পাইতেন, কখনো নপরেশিঙ্গনের মতন শনা যাইত; বসিয়া বসিয়া মনে-মনে ভাবিতেন, সে কেমন দইখানি চরণ যাহাতে সেই সোনার নপর বাঁধা থাকিয়া তালে তালে গান গাহিতেছে। সেই দুইখানি রন্তিম শত্র কোমল চরণতল প্রতি পদক্ষেপে কণী সৌভাগ্য কী অনুগ্রহ কী কর্ণার মতো করিয়া পথিবীকে পশ করে। মনের মধ্যে সেই চরণদুটি প্রতিষ্ঠা করিয়া কবি অবসরকালে সেইখানে আসিয়া লটাইয়া পড়িত এবং সেই ন পরশিঙ্গনের সরে আপনার গান বধিত। কিন্তু, যে ছায়া দেখিয়ছিল, যে নপরে শনিয়াছিল, সে কাহার ছায়া, কাহার নপর, এমন তক এমন সংশয় তাহার ভক্তহৃদয়ে কখনো উদয় হয় নাই। রাজকন্যার দাসী মঞ্জরী যখন ঘাটে যাইত শেখরের ঘরের সম্মখে দিয়া তাহার পথ ছিল। আসিতে যাইতে কবির সঙ্গে তাহার দটো কথা না হইয়া যাইত না । তেমন নিজন দেখিলে সে সকালে সন্ধ্যায় শেখরের ঘরের মধ্যে গিয়াও বসিত। যতবার সে ঘাটে যাইত ততবার যে তাহার আবশ্যক ছিল এমনও বোধ হইত না, যদি-বা আবশ্যক ছিল এমন হয় কিন্তু ঘাটে যাইবার সময় উহারই মধ্যে একট বিশেষ যত্ন করিয়া একটা রঙিন কাপড় এবং কানে দুইটা আমম কুল পরিবার কোনো উচিত কারণ পাওয়া যাইত না। লোকে হাসাহাসি কানাকানি করিত। লোকের কোনো অপরাধ ছিল না। মঞ্জরীকে দেখিলে শেখর বিশেষ আনন্দলাভ করিতেন। তাহা গোপন করিতেও তাঁহার তেমন প্রয়াস ছিল না । তাহার নাম ছিল মঞ্জরী ; বিবেচনা করিযা দেখিলে, সাধারণ লোকের পক্ষে সেই নামই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু শেখর আবার আরও একট কবিত্ব করিয়া তাহাকে বসন্তমঞ্জরী বলিতেন। লোকে শুনিয়া বলিত, “আ সবনাশ!" আবার কবির বসন্তবর্ণনার মধ্যে মঙ্গলবঞ্জলমঞ্জরী এমনতর অন্যপ্রাসও মাকে মাঝে পাওয়া যাইত। এমনকি, জনরব রাজার কানেও উঠিয়াছিল। রাজা তাঁহার কবির এইরুপ রসাধিক্যের পরিচয় পাইয়া বড়োই আমোদ বোধ করিতেন— তাহা লইয়া কৌতুক করিতেন, শেখরও তাহাতে যোগ দিতেন। রাজা হাসিয়া প্রশ্ন করিতেন, “শ্রমর কি কেবল বসন্তের রাজসভায় গান গায় ।” কবি উত্তর দিতেন, “না, পাপমঞ্জরীর মধ্যও খাইয়া থাকে।” এমনি করিয়া সকলেই হাসিত, আমোদ করিত; বোধ করি অন্তঃপরে রাজকন্যা