পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७ O O গল্পগুচ্ছ বৎসর নিতান্তই অবজ্ঞা করিয়া কালীপদর কাছে কেহ চাঁদা চাহিতেও আসে নাই। এ বৎসর কেবল তাহাকে বিরক্ত করিবার জন্যই তাহার নিকট চাঁদার খাতা আনিয়া ধরিল। যে দলের নিকট হইতে কোনোদিন কালীপদ কিছমাত্র সাহায্য লয় নাই, যাহাদের প্রায় নিত্য-অনুষ্ঠিত আমোদপ্রমোদে যোগ দিবার সৌভাগ্য সে একেবারে তখন জানি না সে কী মনে করিয়া পাঁচটা টাকা দিয়া ফেলিল। পাঁচ টাকা শৈলেন তাহার দলের লোক কাহারও নিকট হইতে পায় নাই । কালীপদর দারিদ্র্যের কৃপণতায় এ-পর্যন্ত সকলেই তাহাকে অবজ্ঞা করিয়া আসিয়াছে, কিন্তু আজ তাহার এই পাঁচ টাকা দান তাহাদের একেবারে অসহ্য হইল। উহার অবস্থা যে কিরপে তাহা তো আমাদের অগোচর নাই, তবে উহার এত বড়াই কিসের। ও ষে দেখি সকলকে টেক্কা দিতে চায় !" সরস্বতীপজা ধম করিয়া হইল—কালীপদ যে পাঁচটা টাকা দিয়াছিল তাহা না দিলেও কোনো ইতরবিশেষ হইত না। কিন্তু, কালীপদর পক্ষে সে কথা বলা চলে না। পরের বাড়িতে তাহাকে খাইতে হইত—সকল দিন সমযমতো আহার জটিত না। তা ছাড়া, পাকশালার ভৃত্যরাই তাহার ভাগ্যবিধাতা, সতবাং ভালোমন্দ কমিবেশি সম্বন্ধে কোনো অপ্রিয় সমালোচনা না করিয়া জলখাবারের জন্য কিছু সম্প্রল তাহাকে হাতে রাখিতেই হইত। সেই সংগতিটুকু গাঁদাফলের শক সতপের সঙ্গে বিসক্তিতি দেবীপ্রতিমার পশ্চাতে অন্তধান করিল। কালীপদর মাথা ধরার উৎপাত বাড়িয়া উঠিল। এবার পরীক্ষায় সে ফেল করিল না বটে, কিন্তু বত্তি পাইল না। কাজেই পড়িবার সময় সংকোচ করিযী তাহাকে আরও একটি টাইশনির জোগাড় করিয়া লইতে হইল। এবং বিস্তর উপদ্রব সত্ত্বেও, বিনা ভাড়ার বাসাটুকু ছাড়িতে পারিল না। উপরিতলবাসীরা আশা করিয়াছিল, এবার ছুটির পরে নিশ্চয়ই কালীপদ এ মেসে আর আসিবে না। কিন্তু, যথাসময়েই তাহার সেই নীচের ঘরটার তালা খলিয়া গেল। ধতির উপর সেই তাহার চিরকেলে চেক-কাট চায়না-কোট পরিয়া কালীপদ কোটরের মধ্যে প্রবেশ করিল, এবং একটা ময়লা-কাপড়ে-বাঁধা মস্ত পটলি-সমেত টিনের বাক্স নামাইয়া রাখিয়া শেয়ালদহের মটে তাহার ঘরের সম্মুখে উব হইয়া বসিয়া অনেক বাদ-প্রতিবাদ করিয়া ভাড়া চুকাইয়া লইল। ঐ পটলিটার গভে নানা হাঁড়ি খরি ভাণ্ডের মধ্যে কালীপদর মা কাঁচা-আম কুল চালতা প্রভৃতি উপকরণে নানাপ্রকার মুখরোচক পদার্থ তৈরি করিয়া নিজে সাজাইয়া দিয়াছেন। কালীপদ জানিত, তাহার অবতমানে কৌতুকপরায়ণ উপরতলার দল তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া থাকে। তাহার আর-কোনো ভাবনা ছিল না, কেবল তাহার বড়ো সংকোচ ছিল পাছে তাহার পিতামাতার কোনো নেহের নিদর্শন এই বিদ্রপকারীদের হাতে পড়ে। তাহার মা তাহাকে যে খাবার জিনিসগুলি দিয়াছেন এ তাহার পক্ষে অমত—কিন্তু এ-সমস্তই তাহার দরিদ্র গ্রামাঘরের আদরের ধন; যে আধারে সেগুলি রক্ষিত সেই ময়দা দিয়া অটিা সরা-ঢাকা হাঁড়ি, তাহার মধ্যেও শহরের ঐশ্বয সঙ্গার কোনো লক্ষণ নাই; তাহা কাচের পাত্র নয়, তাহা চিনামাটির ভান্ডও নহে-কিন্তু এইগুলিকে কোনো শহরের ছেলে যে অবজ্ঞা করিয়া দেখিবে, ইহা তাহার পক্ষে একেবারেই