পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪

মধ্যে পুরাবৃত্ত আছে, রাজনৈতিক ইতিহাস আছে, ধর্ম্মজগতের একটী বিশাল প্রবাহের প্রতিবিম্ব আছে, ভাষাতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব আলোচনার নূতন উপাদান আছে। ময়নামতীর গাথা মার্জ্জিত কবির পাণ্ডিত্য-শূন্য হইলেও একেবারে কবিত্ব-শূন্য নহে। ইহাতে প্রসাদগুণ আছে, শ্লেষ আছে, অনেক স্থলেই মানব প্রকৃতির প্রকৃত আলেখ্য আছে। অতিপ্রাকৃত ঘটনার অতিরিক্ত সমাবেশ সত্ত্বেও কবিতা দেবীর অঙ্গ-সৌরভ দুরীকৃত হয় নাই।” এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হইবার পর বঙ্গের অন্য স্থান হইতে যে অন্যান্য গাথা আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহাতে এই সকল তত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্র প্রশস্ত বই সঙ্কুচিত হয় নাই। অনৈক্য ও অসামঞ্জস্য অধিকতর পরিস্ফুট হইয়া ঐতিহাসিককে অধিকতর সতর্ক করিয়া দিয়াছে, কিন্তু গবেষণার উপাদান অনেক বাড়িয়া গিয়াছে।

গোরক্ষানাথের সময় এখন দেখা যাউক যাঁহারা এই গাথা গুলির নায়ক তাঁহারা কোন সময়ের লোক। গাথার প্রমাণানুসারে সাধারণতঃ ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে যে ময়নামতী “গোরক্ষনাথের শিষ্য, গোপীচন্দ্র হাড়িপার শিষ্য ছিলেন। ময়নামতী, গোপীচন্দ্র, গোরক্ষনাথ ও হাড়িপা কোন সময়ে বিদ্যমান ছিলেন এবং তাঁহাদিগের প্রবর্ত্তিত বা অবলম্বিত নাথধর্ম্মই বা কত দিনের? শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ বিঘাভূষণ মহাশয় নাথপন্থ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করিয়াছেন। তাঁহার মতে নাথপন্থ খৃষ্টীয় নবম শতকের শেষে প্রথমে বঙ্গদেশে প্রভুত্ব বিস্তার করে, তারপর ভারতের অন্যান্য প্রদেশে বিস্তৃতি লাভ করে।[১] নাথদের মধ্যে গোরক্ষনাথের প্রতিপত্তি খুব অধিক, কিন্তু তাঁহার সময় সম্বন্ধে এত বিভিন্ন মত প্রচলিত যে, তাহা হইতে সত্য উদ্ধার করা যারপর-নাই কঠিন। খুব সম্ভবতঃ একাধিক গোরক্ষনাথ বিদ্যমান ছিলেন। নেপালের ইতিহাস প্রণেতা রাইট্ সাহেব স্থানীয় উপকরণ হইতে বলেন যে, নেপালরাজ বরদেবের সময়ে গোরক্ষনাথ নেপালে আগমন করেন। কথিত আছে কলির ৩৪০০ বৎসর গত হইলে বীরদেব নেপালের রাজমুকুট ধারণ করেন। বীরদেব হইতে চতুর্থ পুরুষে বরদেব। এই হিসাবে খৃঃ ৫ম শতকের প্রথম ভাগে গোরক্ষনাথের প্রাদুর্ভাব। আবার সিলভ্যা লেভি তাঁহার Le Nepal গ্রন্থে বলেন যে, খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে রাজা নরেন্দ্রনাথের সময়ে গোরক্ষনাথ বিদ্যমান ছিলেন। কচ্ছ প্রদেশের ধারণানুসারে গোরক্ষনাথ ধরমনাথ নামক সাধু পুরুষের সতীর্থ ছিলেন। ধরমনাথের শিষ্য দ্বাদশ শতকের শেষভাগে বা ত্রয়োদশ শতকের প্রথমে জাটদিগকে দূরীভূত করিয়া রায়ধনকে বরার রাজসিংহাসনে স্থাপিত করেন। এই হিসাবে গোরক্ষনাথ দ্বাদশ শতাব্দীর লোক হইয়া পড়েন। পক্ষান্তরে দলপতরাম প্রাণজীবন থক্কর তাঁহার
  1. প্রবাসী, ১৩২৮।