পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভারতবর্ষের লোককে যদি আপনি অব্রাহ্ম বলে দেখেন, তা হলে তাদের বিকৃত করে দেখবেন এবং তাদের অবজ্ঞা করবেন; তা হলে তাদের কেবলই ভুল বুঝতে থাকবেন। যেখান থেকে দেখলে তাদের সম্পূর্ণ দেখা যায় সেখান থেকে তাদের দেখাই হবে না। ঈশ্বর এদের মানুষ করে সৃষ্টি করেছেন, এরা নানারকম করে ভাবে, নানারকম করে চলে, এদের বিশ্বাস এদের সংস্কার নানারকম কিন্তু সমন্তেরই ভিত্তিতে একটি মনুষ্যত্ব আছে; সমন্তেরই ভিতরে এমন একটি জিনিস আছে যা আমার জিনিস, যা আমার এই ভারতবর্ষের জিনিস, যার প্রতি ঠিক সত্যদৃষ্টি নিক্ষেপ করলে তার সমস্ত ক্ষুদ্রতা-অসম্পূর্ণতার আবরণ ভেদ করে একটি আশ্চর্য মহৎসত্তা চোখের উপরে পড়ে; অনেক দিনের অনেক সাধনা তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন দেখা যায়, দেখতে পাই অনেক কালের হোমের অগ্নি ভস্মের মধ্যে এখনো জ্বলছে এবং সেই অগ্নি একদিন আপনার ক্ষুদ্র দেশকালকে ছাড়িয়ে উঠে পৃথিবীর মাঝখানে তার শিখাকে জাগিয়ে তুলবে তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ থাকে না; এই ভারতবর্ষের মানুষ অনেক দিন থেকে অনেক বড়ো কথা বলেছে, অনেক বড়ো কাজ করেছে, সে-সমস্তই একেবারে মিথ্যা হয়ে গেছে এ কথা কল্পনা করাও সত্যের প্রতি অশ্রদ্ধা, সেই তো নাস্তিকতা।”

 সুচরিতা মুখ নিচু করিয়া শুনিতেছিল। সে মুখ তুলিয়া কহিল, “আপনি আমাকে কী করতে বলেন?”

 গোরা কহিল, “আর কিছু বলি নে— আমি কেবল বলি আপনাকে এই কথাটা বুঝে দেখতে হবে যে, হিন্দুধর্ম মায়ের মতো নানা ভাবের নানা মতের লোককে কোল দেবার চেষ্টা করেছে; অর্থাৎ কেবল হিন্দুধর্মই জগতে মানুষকে মানুষ বলেই স্বীকার করেছে, দলের লোক বলে গণ্য করে নি। হিন্দুধর্ম মূঢ়কেও মানে, জ্ঞানীকেও মানে- এবং কেবলমাত্র জ্ঞানের এক মূর্তিকেই মানে না, জ্ঞানের বহুপ্রকার বিকাশকে মানে। খৃস্টানরা বৈচিত্র্যকে স্বীকার করতে চায় না; তারা বলে, এক পারে খৃস্টানধর্ম আর-এক পারে অনন্ত বিনাশ, এর মাঝখানে কোনো বিচিত্রতা নেই। আমরা

৪৪৪