পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 ইতিমধ্যে যখন সিপাহিদের ম্যুটিনি বাধিল সেই সময় কৌশলে দুই-একজন উচ্চপদস্থ ইংরেজের প্রাণরক্ষা করিয়া ইনি যশ এবং জায়গির লাভ করেন। ম্যুটিনির কিছুকাল পরেই কাজ ছাড়িয়া দিলেন এবং নবজাত গোরাকে লইয়া কিছুদিন কাশীতে কাটাইলেন। গোরার বয়স যখন বছর পাঁচেক হইল তখন কৃষ্ণদয়াল কলিকাতায় আসিয়া তাঁহার বড়ো ছেলে মহিমকে তাহার মামার বাড়ি হইতে নিজের কাছে আনাইয়া মানুষ করিলেন। এখন মহিম পিতার মুরুব্বিদের অনুগ্রহে সরকারি খাতাঞ্জিখানায় খুব তেজের সঙ্গে কাজ চালাইতেছে।

 গোরা শিশুকাল হইতেই তাহার পাড়ার এবং ইস্কুলের ছেলেদের সর্দারি করিত। মাস্টার-পণ্ডিতের জীবন অসহ্য করিয়া তোলাই তাহার প্রধান কাজ এবং আমোদ ছিল। একটু বয়স হইতেই সে ছাত্রদের ক্লাবে ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’এবং ‘বিংশতি কোটি মানবের বাস’ আওড়াইয়া, ইংরেজিভাষায় বক্তৃতা করিয়া, ক্ষুদ্র বিদ্রোহীদের দলপতি হইয়া উঠিল। অবশেষে যখন এক সময় ছাত্রসভার ডিম্ব ভেদ করিয়া গোরা বয়স্কসভায় কাকলি বিস্তার করিতে আরম্ভ করিল তখন কৃষ্ণদয়ালবাবুর কাছে সেটা অত্যন্ত কৌতুকের বিষয় বলিয়া মনে হইল।

 বাহিরের লোকের কাছে গোরার প্রতিপত্তি দেখিতে দেখিতে বাড়িয়া উঠিল; কিন্তু ঘরে কাহারও কাছে সে বড়ো আমল পাইল না। মহিম তখন চাকরি করে— সে গোরাকে কখনো বা ‘পেট্রিয়ট-জেঠা’ কখনো বা ‘হরিশ মুখুজ্জে দি সেকেণ্ড্’ বলিয়া নানাপ্রকারে দমন করিতে চেষ্টা করিয়াছিল। তখন দাদার সঙ্গে গোরার প্রায় মাঝে মাঝে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইত। আনন্দময়ী গোরার ইংরেজ-বিদ্বেষে মনে মনে অত্যন্ত উদ্‌বেগ অনুভব করিতেন; তাহাকে নানাপ্রকারে ঠাণ্ডা করিবার চেষ্টা করিতেন, কিন্তু কোনো ফলই হইত না। গোরা রাস্তায় ঘাটে কোনো সুযোগে ইংরেজের সঙ্গে মারামারি করিতে পারিলে জীবন ধন্য মনে করিত।

 এ দিকে কেশববাবুর বক্তৃতায় মুগ্ধ হইয়া গোরা ব্রাহ্মসমাজের প্রতি

৩৭