পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২২
ঘরে-বাইরে

 এই পর্যন্ত লিখেছি— এ গেল আমার খাসের কথা। এ-সব কথা আমার অবকাশের সময় আরাে ফুটিয়ে তােলা যাবে। এখন অবকাশ নেই। এখানকার নায়েব খবর পাঠিয়েছে, এখনই একবার তার কাছে যাওয়া চাই। শুনছি, একটা গােলমাল বেধেছে।


নায়েব বললে, যে লােকটার দ্বারা নৌকো ডােবানাে হয়েছিল পুলিস তাকে সন্দেহ করেছে। লােকটা পুরােনাে দাগী; তাকে নিয়ে টানাটানি চলছে। লােকটা সেয়ানা, তার কাছ থেকে কথা আদায় করা শক্ত হবে। কিন্তু বলা যায় কি! বিশেষত নিখিল রেগে রয়েছে, নায়েব স্পষ্ট তাে কিছু করতে পারবে না। নায়েব আমাকে বললে, দেখুন, আমাকে যদি বিপদে পড়তে হয় আমি আপনাকে ছাড়ব না।

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, আমাকে যে জড়াবে তার ফাঁস কোথায়?

 নায়েব বললে, আপনার লেখা একখানা আর অমূল্যবাবুর লেখা তিনখানা চিঠি আমার কাছে আছে।

 এখন বুঝছি, যে চিঠিখানা লিখে নায়েব আমার কাছ থেকে জবাব আদায় করে রেখেছিল সেটা এই কারণেই জরুরি, তার আর-কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। এ-সব চাল নূতন শেখা যাচ্ছে। যেমন করে শত্রুর নৌকো ডুবিয়েছি প্রয়ােজন হলেই তেমনি করে যে মিত্রকেও অনায়াসে ডােবাতে পারি, আমার ’পরে নায়েবের এই শ্রদ্ধাটুকু ছিল। শ্রদ্ধা আরাে অনেকখানি বাড়ত যদি চিঠিখানার জবাব লিখে না দিয়ে মুখে দেওয়া যেত।

 এখন কথা হচ্ছে এই, পুলিসকে ঘুষ দেওয়া চাই এবং যদি আরাে কিছুদূর গড়ায় তা হলে যে লােকটার নৌকো ডুবনো গেছে আপসে তারও ক্ষতিপূরণ করতে হবে। এখন বেশ বুঝতে পারছি, এই-যে বেড়-জালটি পাতা হচ্ছে এর মুনফার একটা মােটা অংশ নায়েবের ভাগেও পড়বে। কিন্তু মনে মনে সে কথাটা চেপেই রাখতে হচ্ছে। মুখে আমিও বলছি বন্দে মাতরং, আর সেও বলছে বন্দে মাতরং।

 এ-সব ব্যাপারে যে আসবাব দিয়ে কাজ চালাতে হয় তার ফাটা অনেক; যেটুকু পদার্থ টিঁকে থাকে তার চেয়ে গলে পড়ে ঢের বেশি। ধর্মবুদ্ধিটা নাকি লুকিয়ে মজ্জার মধ্যে সেঁধিয়ে বসে আছে, সেইজন্যে নায়েবটার উপর প্রথম দফায় খুব রাগ হয়েছিল, আর-একটু হলেই দেশের লােকের কপটতা সম্বন্ধে খুব কড়া কথা এই ডায়ারিতে লিখতে বসেছিলুম। কিন্তু ভগবান যদি থাকেন তাঁর কাছে আমার এই কৃতজ্ঞতাটুকু স্বীকার করতেই হবে, তিনি আমার