পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬২
ঘরে-বাইরে

 সন্দীপ, আমি তােমাকে পরামর্শ দিই নি, তুমিও আমাকে পরামর্শ না দিলে চলত। ওটা বৃথা হচ্ছে। আর-একটি কথা আমার বলবার আছে। তােমরা কিছুদিন থেকে দলবল নিয়ে আমার প্রজাদের ’পরে ভিতরে ভিতরে উৎপাত করছ। আর চলবে না, এখন তােমাকে আমার এলেকা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।

 মুসলমানের ভয়ে, না, আরাে কোনাে ভয় আছে?

 এমন ভয় আছে যে ভয় না থাকাই কাপুরুষতা; আমি সেই ভয় থেকেই বলছি তােমাকে যেতে হবে সন্দীপ। আর দিন-পাঁচেক পরে আমি কলকাতায় যাচ্ছি, সেই সময় তােমারও আমার সঙ্গে যাওয়া চাই। আমাদের কলকাতার বাড়িতে থাকতে পার, তাতে কোনাে বাধা নেই।

 আচ্ছা, পাঁচ দিন ভাববার সময় পাওয়া গেল। ইতিমধ্যে মক্ষীরানী, তােমার মউচাক থেকে বিদায় হবার গুঞ্জনগান করে নেওয়া যাক। হে আধুনিক বাংলার কবি, খােলো তােমার দ্বার, তােমার বাণী লুঠ করে নিই— চুরি তােমারই তুমি আমারই গানকে তােমার গান করেছ— নাহয় নাম তােমার হল, কিন্তু গান আমার।

 এই বলে তার বেসুর-ঘেঁষা মােটা ভাঙা গলায় ভৈরবীতে গান ধরলে—

মধুঋতু নিত্য হয়ে রইল তােমার মধুর দেশে!
যাওয়া-আসার কান্নাহাসি হাওয়ায় সেথা বেড়ায় ভেসে।
যায় যে জনা সেই শুধু যায়,  ফুল ফোটা তাে ফুরােয় না হায়,
ঝরবে যে ফুল সেই কেবলই ঝরে পড়ে বেলাশেষে।
যখন আমি ছিলেম কাছে তখন কত দিয়েছি গান।
এখন আমার দূরে-যাওয়া, এরও কি গাে নাই কোনাে দান?
পুষ্পবনের ছায়ায় ঢেকে  এই আশা তাই গেলেম রেখে—
আগুন-ভরা ফাগুনকে তাের কাঁদায় যেন আষাঢ় এসে।

 সাহসের অন্ত নেই— সে সাহসের কোনাে আবরণও নেই, একেবারে আগুনের মতাে নগ্ন। তাকে বাধা দেওয়ার সময় পাওয়া যায় না; তাকে নিষেধ করা যেন বজ্রকে নিষেধ করা, বিদ্যুৎ সে নিষেধ হেসে উড়িয়ে দেয়।

 আমি বাইরে বেরিয়ে এলুম। বাড়ির ভিতরের দিকে যখন চলে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি, অমূল্য কোথা থেকে এসে আমার সামনে দাঁড়ালাে। বললে, রানীদিদি, তুমি কিচ্ছু ভেবাে না। আমি চললুম, কিছুতেই নিষ্ফল হয়ে ফিরব না।