পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৭৭

কাজ নেই। এখন আমার একটি কথা তােমাকে শুনতে হবে। এখনই তুমি বাড়ি যাও। যাও তােমার মায়ের কাছে।

 অমূল্য চাদরের ভিতর থেকে একটা পুঁটুলি বের করে বললে, দিদি, ছ হাজার টাকা এনেছি।

 জিজ্ঞাসা করলুম, কোথায় পেলে?

 তার কোনাে উত্তর না দিয়ে বললে, গিনির জন্যে অনেক চেষ্টা করলুম, সে হল না, তাই নােট এনেছি।

 অমূল্য, মাথা খাও, সত্যি করে বলাে এ টাকা কোথায় পেলে?

 সে আপনাকে বলব না।

 আমি চোখে যেন অন্ধকার দেখতে লাগলুম। বললুম, কী কাণ্ড করেছ অমূল্য? এ টাকা কি—

 অমূল্য বলে উঠল, আমি জানি, তুমি বলবে এ টাকা আমি অন্যায় করে এনেছি। আচ্ছা, তাই স্বীকার। কিন্তু, যত বড়াে অন্যায় তত বড়ােই দাম, সে দাম আমি দিয়েছি। এখন এ টাকা আমার।

 এ টাকার সমস্ত বিবরণ আমার আর শুনতে ইচ্ছে হল না। শিরগুলাে সংকুচিত হয়ে আমার সমস্ত শরীরকে যেন গুটিয়ে আনতে লাগল। আমি বললুম, নিয়ে যাও অমূল্য, এ টাকা যেখান থেকে নিয়ে এসেছ এখনই সেখানে দিয়ে এসাে।

 সে যে বড়াে শক্ত কথা।

 না, শক্ত নয় ভাই! কী কুক্ষণে তুমি আমার কাছে এসেছিলে! সন্দীপও তােমার যত বড়ো অনিষ্ট করতে পারে নি আমি তাই করলুম।

 সন্দীপের নামটা যেন তাকে খোঁচা মারলে। সে বললে, সন্দীপ! তােমার কাছে এলুম বলেই তাে ওকে চিনতে পেরেছি। জান দিদি? তােমার কাছ থেকে সেদিন ও যে ছ হাজার টাকার গিনি নিয়ে গেছে তার থেকে এক পয়সাও খরচ করে নি। এখান থেকে গিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রুমাল থেকে সমস্ত গিনি মেজের উপর ঢেলে রাশ করে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বললে, এ টাকা নয়, এ ঐশ্বর্য-পারিজাতের পাপড়ি। এ অলকাপুরীর বাঁশি থেকে সুরের মতাে ঝরে পড়তে পড়তে শক্ত হয়ে উঠেছে। একে তাে ব্যাঙ্কনােটে ভাঙানাে চলে না, এ যে সুন্দরীর কণ্ঠহার হয়ে থাকবার কামনা করছে। ওরে অমূল্য, তােরা একে স্থূল দৃষ্টিতে দেখিস নে। এ হচ্ছে লক্ষ্মীর হাসি, ইন্দ্রাণীর লাবণ্য। না না, ঐ অরসিক নায়েবটার হাতে পড়বার জন্যে এর সৃষ্টি হয় নি। দেখাে অমূল্য, নায়েবটা নিছক মিথ্যা