পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৫

মাছের ঝোল ভালোবাসে সে মাছকে কেটেকুটে, সাঁতলে, সিদ্ধ করে, মসলা দিয়ে নিজের মনের মতোটি করে নেয়। কিন্তু যে-লোক মাছকেই সত্য। ভালোবাসে সে তাকে পিতলের হাঁড়িতে বেঁধে পাথরের বাটিতে ভর্তি করতে চায় না— সে তাকে ছাড়া জলের মধ্যেই বশ করতে পারে তো ভালো, না পারে তো ডাঙায় বসে অপেক্ষা করে; তার পরে যখন ঘরে ফেরে তখন এইটুকু সান্ত্বনা থাকে যে, যাকে চাই তাকে পাই নি, কিন্তু নিজের শখের বা সুবিধার জন্যে তাকে ছেঁটে ফেলে নষ্ট করি নি। আস্ত পাওয়াটাই সব চেয়ে ভালো, নিতান্তই যদি তা সম্ভব না হয় তবে আস্ত হারানোটাও ভালো।

 এ-সব কথা আমার একেবারেই ভালো লাগত না, কিন্তু সেইজন্যেই যে তখন বের হই নি তা নয়। আমার দিদিশাশুড়ি তখন বেঁচে ছিলেন। তাঁর অমতে আমার স্বামী বিংশ শতাব্দীর প্রায় বিশ-আনা দিয়েই ঘর ভর্তি করে তুলেছিলেন, তিনিও সয়েছিলেন; রাজবাড়ির বউ যদি পর্দা ঘুচিয়ে বাইরে বেরোত তা হলেও তিনি সইতেন— তিনি নিশ্চয় জানতেন, এটাও একদিন ঘটবে— কিন্তু আমি ভাবতুম, এটা এতই কী জরুরি তাকে কষ্ট দিতে যাব? বইয়ে পড়েছি, আমরা খাঁচার পাখি; কিন্তু অন্যের কথা জানি নে, এই খাঁচার মধ্যে আমার এত ধরেছে যে বিশ্বেও তা ধরে না। অন্তত তখন তো সেইরকমই ভাবতুম।

 আমার দিদিশাশুড়ি যে আমাকে এত ভালোবাসতেন তার গোড়ার কারণটা এই যে, তাঁর বিশ্বাস আমি আমার স্বামীর ভালোবাসা টানতে পেরেছিলুম সেটা যেন কেবল আমারই গুণ, কিংবা আমার গ্রহনক্ষত্রের চক্রান্ত। কেননা, পুরুষ-মানুষের ধর্মই হচ্ছে রসাতলে তলিয়ে যাওয়া। তার অন্য কোনো নাতিকে তার নাতবউরা সমস্ত রূপযৌবন দিয়েও ঘরের দিকে টানতে পারে নি— তাঁরা পাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন, কেউ তাদের বাঁচাতে পারল না। তাঁদের ঘরে পুরুষ-মানুষের এই মরণের আগুন আমিই নেবালুম, এই ছিল তার ধারণা। সেইজন্যেই তিনি আমাকে যেন বুকে করে রেখেছিলেন— আমার একটু অসুখ-বিসুখ হলে তিনি ভয়ে কাঁপতেন। আমার স্বামী সাহেবের দোকান থেকে যে-সমস্ত সাজসজ্জা এনে সাজাতেন সে তাঁর পছন্দসই ছিল না, কিন্তু তিনি ভাবতেন, পুরুষ-মানুষের এমন কতকগুলো শখ থাকবেই যা নিতান্ত বাজে, যাতে কেবলই লোকসান। তাকে ঠেকাতে গেলেও চলবে না, অথচ সে যদি সর্বনাশ পর্যন্ত না পৌছয় তবেই রক্ষে। আমার নিখিলেশ বউকে যদি না সাজাত আর-কাউকে