পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯৬
ঘরে-বাইরে

 এই উৎপাতের শাসনকে অমান্য করি এমন সাধ্য আমার নেই। সংসারে এ যে বড়াে দুর্লভ। থাক্ গে, দারােগাবাবু বসে বসে পিঠে খাক গে। নাহয় হল আমার কাজের অবহেলা।

 ইতিমধ্যে সেই ডাকাতি নিয়ে দারােগা দু-পাঁচজনকে ধরা-পাকড়া করছেই। রােজই একটা-না-একটা নিরীহ লােককে ধরে-বেঁধে এনে আসর গরম করে রেখেছে; আজও বােধ হয় তেমনি কোন্-এক অভাগাকে পাকড়া করে এনেছে। কিন্তু পিঠে কি একলা দারােগাই খাবে? সে তাে ঠিক নয়। দরজায় দমাদম ঘা লাগালুম। মেজোরানী বাইরে থেকে বললেন, জল ঢালাে, জল ঢালাে, মাথা গরম হয়ে উঠেছে বুঝি?

 আমি বললুম, পিঠে দুজনের মতাে সাজিয়ে পাঠিয়ে। দারােগা যাকে চোর বলে ধরেছে পিঠে তারই প্রাপ্য; বেহারাকে বলে দিয়ো তার ভাগে যেন বেশি পড়ে।

 যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি স্নান সেরেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলুম। দেখি, দরজার বাইরে মাটির উপরে বিমল বসে। এ কি আমার সেই বিমল, সেই তেজে অভিমানে ভরা গরবিনী! কোন্ ভিক্ষা মনের মধ্যে নিয়ে এ আমার দরজাতেও বসে থাকে। আমি একটু থমকে দাঁড়াতেই সে উঠে মুখ একটু নিচু করে আমাকে বললে, তােমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।

 আমি বললুম, তা হলে এসাে আমাদের ঘরে।

 কোনাে বিশেষ কাজে কি তুমি বাইরে যাচ্ছ?

 হাঁ, কিন্তু থাক্ সে কাজ, আগে তােমার সঙ্গে—

 না, তুমি কাজ সেরে এসাে— তার পরে তােমার খাওয়া হলে কথা হবে।

 বাইরে গিয়ে দেখি দারােগার পাত্র শূন্য, সে যাকে ধরে এনেছে সে তখনাে বসে বসে পিঠে খাচ্ছে।

 আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, এ কী অমূল্য যে!

 সে এক-মুখ পিঠে নিয়ে বললে, আজ্ঞে হাঁ। পেট ভরে খেয়ে নিয়েছি, এখন কিছু যদি না মনে করেন তা হলে যে ক’টা বাকি আছে রুমালে বেঁধে নিই।— বলে পিঠেগুলাে সব রুমালে বেঁধে নিলে।

 আমি দারােগার দিকে চেয়ে বললুম, ব্যাপারখানা কী?

 দারােগা হেসে বললে, মহারাজ, চোরের হেঁয়ালি তাে হেঁয়ালিই রয়ে গেছে, তার উপরে চোরাই মালের হেঁয়ালি নিয়ে মাথা ঘোরাচ্ছি।

 এই বলে একটা ছেড়া ন্যাক্‌ড়ার পুঁটুলি খুলে এক-তাড়া নোট সে আমার সামনে ধরলে। বললে, এই মহারাজের ছ হাজার টাকা।