পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
৪৯

ঠেলে ঘরের দিকে এগোলুম। যখন প্রায় দরজার কাছ-বরাবর পৌছেছি এমন সময় তাড়াতাড়ি সে কর্তব্য পালন করবার জন্যে ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরে বললে, বাবু যাবেন না।

 কী! আমার গায়ে হাত! আমি হাত ছিনিয়ে নিয়ে তার গালে এক চড় কষিয়ে দিলুম। এমন সময় মক্ষী ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই দেখে দরোয়ান আমাকে অপমান করবার উপক্রম করছে।

 তার সেই মূর্তি আমি কখনো ভুলব না। মক্ষী যে সুন্দরী সেটা আমার আবিষ্কার। আমাদের দেশে অধিকাংশ লোক ওর দিকে তাকাবে না। লম্বা ছিপছিপে গড়ন, যাকে আমাদের রূপরসজ্ঞ লোকেরা নিন্দে করে বলে ‘ঢ্যাঙা’। ওর ঐ লম্বা গড়নটিই আমাকে মুগ্ধ করে, যেন প্রাণের ফোয়ারার ধারা— সৃষ্টিকর্তার হৃদয়গুহা থেকে বেগে উপরের দিকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। ওর রঙ শালা। কিন্তু সে যে ইস্পাতের তলোয়ারের মতো শালা— কী তেজ আর কী ধার! সেই তেজ সেদিন ওর সমস্ত মুখে চোখে ঝিমিক্ করে উঠল। চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে তর্জনী তুলে রানী বললে, ননকু, চলা যাও!

 আমি বললুম, আপনি রাগ করবেন না, নিষেধ যখন আছে তখন আমিই চলে যাচ্ছি।

 মক্ষী কম্পিত স্বরে বললে, না, আপনি যাবেন না— ঘরে আসুন। এ তো অনুরোধ নয়, এ হুকম। আমি ঘরে এসে চৌকিতে বসে একটা হাতপাখা নিয়ে হাওয়া খেতে লাগলুম। মক্ষী একটা কাগজের টুকরোয় পেনসিল দিয়ে কী লিখে বেহারাকে ডেকে বললে, বাবুকে দিয়ে এসো।

 আমি বললুম, আমাকে মাপ করবেন, ধৈর্য রাখতে পারি নি— দরোয়ানটাকে মেরেছি।

 মক্ষী বলল, বেশ করেছেন।

 কিন্তু ও বেচারার তো কোনো দোষ নেই। ও তো কর্তব্য পালন করেছে।

 এমন সময় নিখিল ঘরে ঢুকল। আমি দ্রুত চৌকি থেকে উঠে তার দিকে পিঠ করে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম।

 মক্ষী নিখিলকে বললে, আজ নকু দরোয়ান সন্দীপবাবুকে অপমান করেছে।

 নিখিল এমনি ভালোমানুষের মতো আশ্চর্য হয়ে বললে ‘কেন’ যে আমি আর থাকতে পারলুম না। মুখ ফিরিয়ে তার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকালুম। ভাবলুম, সাধুলোকের সত্যের বড়াই স্ত্রীর কাছে টেকে না, যদি তেমন স্ত্রী হয়।