পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
৭১

করলুম। আমি জানি, তাঁর চোখে এই জ্যাকেটটির সঙ্গে আমার একটি বিশেষ পরিচয় জড়িত আছে।

 আমাকে যে-বারান্দা দিয়ে বাইরে যেতে হবে তখন সেই বারান্দায় বসে আমার মেজো জা তার নিয়মিত সুপুরি কাটছেন। আজ আমি কিছুতেই সংকোচ করলুম না। মেজো জা জিজ্ঞাসা করলেন, বলি, চলেছ কোথায়?

 আমি বললুম, বৈঠকখানা-ঘরে।

 এত সকালে? গােষ্ঠলীলা বুঝি?

 আমি কোনাে জবাব না দিয়ে চলে গেলুম।

 মেজো জা গান ধরলেন—

রাই আমার চলে যেতে ঢলে পড়ে।
অগাধ জলের মকর যেমন,
ও তার চিটে চিনি জ্ঞান নেই।


 বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে দেখি, সন্দীপ দরজার দিকে পিঠ করে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিতে প্রদর্শিত ছবির তালিকার একখানা বই মন দিয়ে দেখছেন। আর্ট সম্বন্ধে সন্দীপ নিজেকে বিচক্ষণ বলেই জানেন। একদিন আমার স্বামী তাঁকে বললেন যে, আর্টিস্টদের যদি গুরুমশায়ের দরকার হয় তবে তুমি বেঁচে থাকতে যােগ্য লােকের অভাব হবে না।

 এমন করে খোঁচা দিয়ে কথা বলা আমার স্বামীর স্বভাব নয়, কিন্তু আজকাল তাঁর মেজাজ একটু বদলে এসেছে— সন্দীপের অহংকারে তিনি ঘা দিতে পারলে ছাড়েন না।

 সন্দীপ বললেন, তুমি কি ভাবাে আর্টিস্টদের আর গুরুকরণ দরকার নেই?

 স্বামী বললেন, আর্ট সম্বন্ধে আর্টিস্টদের কাছ থেকেই আমাদের মতাে মানুষকে চিরকাল নতুন নতুন পাঠ নিয়ে চলতে হবে, কেননা এর কোনাে একটিমাত্র বাঁধা পাঠ নেই।

 সন্দীপ আমার স্বামীর বিনয়কে বিদ্রূপ করে খুব হাসলেন; বললেন, নিখিল, তুমি ভাবাে দৈন্যটাই হচ্ছে মূলধন, ওটাকে যত খাটাবে ঐশ্বর্য ততই বাড়বে। আমি বলছি, অহংকার যার নেই সে স্রোতের শ্যাওলা, চারি দিকে কেবল ভেসে ভেসে বেড়ায়।

 আমার মনের ভাব ছিল অদ্ভুত-রকম। এক দিকে ইচ্ছেটা— তর্কে আমার স্বামীর জিত হয়, সন্দীপের অহংকারটা একটু কমে। অথচ সন্দীপের অসংকোচ অহংকারটাই আমাকে টানে— সে যেন দামী হীরের ঝক্‌মকানি, কিছুতেই