পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
৮১

দাঁড়ায় এই, আপনাকে না-জানাটাই হচ্ছে জানা। সে বলে, তুমি যাকে ফল পাওয়া বলো সে হচ্ছে আপনাকে বাদ দিয়ে ফলটুকুকে পাওয়া। ফলের চেয়ে আত্মা বড়াে।

 আমি বললুম, কথাটা নেহাত ঝাপসা হল।

 নিখিল বললে, উপায় নেই। প্রাণটা কলের চেয়ে অস্পষ্ট, তাই বলে প্রাণটাকে কল বলে সােজা করে জানলেই যে প্রাণটাকে জানা হয় তা নয়। তেমনি আত্মা ফলের চেয়ে অস্পষ্ট, তাই আত্মাকে ফলের মধ্যে চরম করে দেখাই যে আত্মাকে সত্য দেখা তা বলব না।

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, তবে তুমি কোথায় আত্মাকে দেখছ? কোন্ নাকের ডগায়, কোন ভ্রূর মাঝখানে?

 সে বললে, আত্মা যেখানে আপনাকে অসীম জানছে, সেখানে ফলকে ছেড়ে এবং ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে।

 তা হলে নিজের দেশ সম্বন্ধে কী বলবে?

 ঐ একই কথা। দেশ যেখানে বলে ‘আমি আমাকেই লক্ষ্য করব’ সেখানে সে ফল পেতে পারে, কিন্তু আত্মাকে হারায়। যেখানে সকলের চেয়ে বড়ােকে সকলের বড়াে করে দেখে সেখানে সকল ফলকেই সে খাওয়াতে পারে, কিন্তু আপনাকে সে পায়।

 ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত কোথায় দেখেছ?

 মানুষ এত বড়াে যে সে যেমন ফলকে অবজ্ঞা করতে পারে তেমনি দৃষ্টান্তকেও। দৃষ্টান্ত হয়তাে নেই; বীজের ভিতরে ফুলের দৃষ্টান্ত যেমন নেই, কিন্তু ধীজের ভিতরে ফুলের বেদনা আছে। তবু, দৃষ্টান্ত কি একেবারেই নেই? বুদ্ধ বহু শতাব্দী ধরে যে সাধনায় সমস্ত ভারতবর্ষকে জাগিয়ে রেখেছিলেন সে কি ফলের সাধনা?

 নিখিলের কথা আমি যে একেবারেই বুঝতে পারি নে তা নয়। কিন্তু সেইটিই হল আমার মুশকিল। ভারতবর্ষে আমার জন্ম, সাত্ত্বিকতার বিষ রক্তের মধ্যে থেকে একেবারে মরতে চায় না। আপনাকে বঞ্চিত করার পথে চলা যে পাগলামি, এ কথা মুখে যতই বলি এটাকে একেবারে উড়িয়ে দেবার সাধ্য নেই। এইজন্যেই আমাদের দেশে আজকাল অদ্ভুত ব্যাপার চলছে। ধর্মের ধুয়াে, দেশের ধুয়াে, দুটিকেই পুরােদমে একসঙ্গে চালাচ্ছি। ভগবদ্গীতা এবং বন্দেমাতরং আমাদের দুইই চাই। তাতে দুটোর কোনােটাই যে স্পষ্ট হতে পারছে না, তাতে একসঙ্গেই গড়ের বাদ্য এবং সানাই বাজানো চলছে, এ আমরা বুঝছি নে। আমার জীবনের কাজ হচ্ছে এই বেসুরাে গােলমালটাকে