দিয়া দব, দব, করিতে লাগিল। যে দরোয়ান চিঠি লইয়া গিয়াছিল, তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইল; সে অন্য কাজে অনুপস্থিত ছিল, তাহাকে পাওয়া গেল না। প্রদীপের মুখ হইতে যেমন জলন্ত তৈলবিন্দু ক্ষরিয়া পড়ে, রুদ্ধ শয়নকক্ষের মধ্যে বিনোদিনীর দীপ্ত নেত্র হইতে তেমনি হৃদয়ের জালা আশ্রজলে গলিয়া পড়িতে লাগিল। নিজের চিঠিখান ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া কুটি-কুটি করিয়া কিছুতেই তাহার সান্ত্বনা হইল না— সেই তুষ্ট-চারি লাইন কালির দাগকে অতীত হইতে, বর্তমান হইতে, একেবারেই মূছিয়া ফেলিবার, একেবারেই ‘না করিয়া দিবার কোনো উপায় নাই কেন। ক্রুদ্ধা মধুকরী যাহাকে সম্মুখে পায় তাহাকেই দংশন করে, ক্ষুদ্ধ বিনোদিনী তেমনি তাহার চারি দিকের সমস্ত সংসারটাকে জালাইবার জন্য প্রস্তুত হইল। সে যাহা চায় তাহাতেই বাধা? কোনো-কিছুতেই কি সে কৃতকার্য হইতে পারিবে না। সুখ যদি না পাইল, তবে যাহারা তাহার সকল সুখের অন্তরায়, যাহারা তাহাকে কৃতার্থতা হইতে ভ্রষ্ট, সমস্ত সম্ভবপর সম্পদ হইতে বঞ্চিত করিয়াছে, তাহাদিগকে পরাস্ত ধুলিলুষ্ঠিত করিলেই তাহার ব্যর্থ জীবনের কর্ম সমাধা হইবে।
সেদিন নূতন ফাল্গুনে প্রথমে বসন্তের হাওয়া দিতেই আশা অনেক দিন পরে সন্ধ্যার আরম্ভে ছাদে মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে। একখানি মাসিক-কাগজ লইয়া খণ্ডশ প্রকাশিত একটা গল্প খুব মনোযোগ দিয়া সেই অল্প আলোকে পড়িতেছিল। গল্পের নায়ক তখন সংবৎসর পরে পূজার ছুটিতে বাড়ি আসিবার সময় ডাকাতের হাতে পড়িয়াছে, আশার হৃদয় উদবেগে কাঁপিতেছিল; এ দিকে হতভাগিনী নায়িকা ঠিক সেই সময়েই বিপদের স্বপ্ন দেখিয়া কাঁদিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে। আশা চোখের জল- আর রাখিতে পারে না। আশা বাংলা গল্পের অত্যন্ত উদার সমালোচক ছিল যাহা পড়িত, তাহাই মনে হইত চমৎকার। বিনোদিনীকে ডাকিয়া বলিত, “ভাই চোখের বালি, মাথা খাও, এ গল্পটি পড়িয়া দেখো। এমন সুন্দর! পড়িয়া আর কাঁদিয়া বাঁচি না।”
বিনোদিনী ভালোমন্দ বিচার করিয়া আশার উচ্ছ্বসিত উৎসাহে বড়ো অfঘাত করিত।
আজিকার এই গল্পটা আশা মহেন্দ্রকে পড়াইবে ৰলিয়া স্থির করিয়। যখন সজলচক্ষে কাগজখানা বন্ধ করিল, এমন সময়ে মহেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল।