চাওয়াচাওয়ি করিল। যেন কী-এটা জনরব শোনা গিয়াছিল, তাহার সহিত লক্ষণ মিলিল।
বিনোদিনী, তাহার পল্লী হইতে সর্বতোভাবে বহু দূরে গিয়া পড়িয়াছে, তাহা পদে পদে অনুভব করিতে লাগিল। স্বগৃহে তাহার নির্বাসন। কোথাও তাহার এক মুহূর্তের আরামের স্থান নাই।
ডাকঘরের বুড়া পেয়াদা বিনোদিনীর আবাল্যপরিচিত। পরদিন বিনোদিনী যখন পুষ্করিণী ঘাটে স্নান করিতে উদ্যত হইয়াছে, এমন সময় চিঠির ব্যাগ লইয়া পেয়াদাকে পথ দিয়া যাইতে দেখিয়া বিনোদিনী আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না। গামছা ফেলিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “পাঁচুদাদা, আমার চিঠি আছে?”
বুড়া কহিল, “না।”
বিনোদিনী ব্যগ্র হইয়া কহিল, “থাকিতেও পারে। একবার দেখি।”
বলিয়া পাড়ার আর খানপাঁচ-ছয় চিঠি লইয়া উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া দেখিল, কোনোটাই তাহার নহে। বিমর্ষমুখে যখন ঘাটে ফিরিয়া আসিল তখন তাহার কোনো সখী সকৌতুক কটাক্ষে কহিল, “কী লো বিন্দি, চিঠির জন্যে এত ব্যস্ত কেন।”
আর-একজন প্রগল্ভা কহিল, “ভালো, ভালো! ডাকের চিঠি আসে এত ভাগ্য কয়জনের। আমাদের তো স্বামী দেবর ভাই বিদেশে কাজ করে, কিন্তু ডাকের পেয়াদার দয়া হয় না।
এইরূপে কথায় কথায় পরিহাস, স্ফূটতর ও কটাক্ষ তীক্ষ্ণতর হইয়া উঠতে লাগিল। বিনোদিনী বিহারীকে অনুনয় করিয়া আসিয়াছিল, প্রত্যহ যদি নিতান্ত না ঘটে, তবে অন্তত সপ্তাহে দুইবার তাহাকে কিছু না হয় তো দুই ছত্রও যেন চিঠি লেখে। আজই বিহারীর চিঠি পাইবার সম্ভাবনা অত্যন্ত বিরল, কি আকাঙ্ক্ষা এত অধিক হইয়া উঠিল যে দূর সম্ভাবনায় আশাও বিনোদিনী ছাড়িতে পারিল না। তাহার মনে হইতে লাগিল, যেন কতকাল কলিকাতা ত্যাগ করিয়াছে।
মহেন্দ্রের সহিত জড়িত করিয়া বিনোদিনীর নামে নিন্দা গ্রামের ঘরে ঘরে কিরূপ ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, শত্রু-মিত্রের কৃপায় বিনোদিনীর কাছে তাহা অগোচর রহিল না। শান্তি কোথায়।
গ্রামবাসী সকলের কাছ হইতে বিনোদিনী নিজেকে নির্লিপ্ত করিয়া লইতে চেষ্টা করিল। পলীর লোকেরা তাহাতে আরো রাগ করিল। পাতকিনীকে কাছে লইয়া ঘৃণা ও পীড়ন করিবার বিলাসসুখ হইতে তাহারা বঞ্চিত হইতে চায় না।