পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৮
ছন্দ

ইহার সহিত নিম্নউদ্ধৃত শ্লোকটি একসঙ্গে পাঠ করিলে প্রভেদ প্রতীয়মান হইবে।

অপ্সরী কিন্নরী দাঁড়াইয়ে তীরে
ধরিয়ে ললিত করুণা-তান,
বাজারে বাজারে বীণা ধীরে ধীরে
গাহিছে আদরে স্নেহের গান।

“অপ্সরী কিন্নরী” যুক্ত-অক্ষর লইয়া এখানে ছন্দোভঙ্গ করিয়াছে।[১] কবিও এই কারণে বঙ্গসুন্দরীতে যথাসাধ্য যুক্ত-অক্ষর বর্জন করিয়া চলিয়াছেন।[২]

 কিন্তু বাংলা যে ছন্দে যুক্ত-অক্ষরের স্থান হয় না সে ছন্দ আদরণীয় নহে। কারণ ছন্দের ঝংকার এবং ধ্বনিবৈচিত্র্য যুক্ত-অক্ষরের উপরেই অধিক নির্ভর করে। একে বাংলা ছন্দে স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা নাই, তার উপরে যদি যুক্ত-অক্ষর বাদ পড়ে, তবে ছন্দ নিতান্তই অস্থিবিহীন সুললিত শব্দপিণ্ড হইয়া পড়ে। তাহা শীঘ্রই শ্রান্তিজনক তন্দ্রাকর্ষক হইয়া উঠে এবং হৃদয়কে আঘাতপূর্বক ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে পারে না।[৩] সংস্কৃত ছন্দে যে বিচিত্র সংগীত তরঙ্গিত হইতে থাকে তাহার প্রধান কারণ স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা এবং যুক্ত-অক্ষরের বাহুল্য। মাইকেল মধুসূদন ছন্দের এই নিগূঢ় তত্ত্বটি অবগত ছিলেন, সেইজন্য তাঁহার অমিত্রাক্ষরে এমন পরিপূর্ণ ধ্বনি এবং তরঙ্গিত গতি অনুভব করা যায়।[৪]

 আর্যদর্শনে বিহারীলালের সারদামঙ্গল-সংগীত যখন প্রথম বাহির হইল, তখন ছন্দের প্রভেদ মুহূর্তেই প্রতীয়মান হইল। সারদামঙ্গলের ছন্দ নূতন নহে, তাহা প্রচলিত ত্রিপদী; কিন্তু কবি তাহা সংগীতে সৌন্দর্যে সিঞ্চিত করিয়া তুলিয়াছেন। বঙ্গসুন্দরীর ছন্দোলালিত্য অনুকরণ করা সহজ, সেই মিষ্টতা একবার অভ্যস্ত হইয়া গেলে তাহার বন্ধন ছেদন করা কঠিন, কিন্তু সারদামঙ্গলের গীতসৌন্দর্য অনুকরণসাধ্য নহে।

 সাধনা—১৩০১ আষাঢ়
  1. তুলনীয়: বদনমণ্ডলে ভাসিছে ব্রীড়া পৃ ৫৫ ও ১২৩, লৌহশৃঙ্খলের ডোর পৃ ৬৬, এবং রয়েছে পড়িয়া শৃঙ্খলে বাঁধা পৃ ৬৭।
  2. প্রাক্‌মানসী যুগের রবীন্দ্রসাহিত্যেও যুক্তাক্ষরবর্জনের প্রয়াস দেখা যায়। লক্ষণীয়: ‘সেইজন্যে যুক্ত-অক্ষর...সমতল করে যাচ্ছিলুম’ ইত্যাদি, পৃ ৬৬-৬৭।
  3. তুলনীয়: জিহ্বা কোথাও...জাগ্রত করিয়া রাখিতে পারে না পৃ ১৭২।
  4. তুলনীয়: মাইকেল তাঁহার মহাকাব্যে...পরিপূর্ণ ধ্বনি নষ্ট হয় পৃ ১৭৪।