পাতা:ছিন্নমুকুল - স্বর্ণকুমারী দেবী.pdf/১৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬০
ছিন্নমুকুল

আমার সংসারে কাজ কি; অর্থে কাজ কি? তোমাকেই যদি না পাই তবে আমার আর কিসে কাজ? আমি ধন সম্পদের আকাঙ্ক্ষী নহি, আমি পদমর্য্যাদার জন্যও লালায়িত নই। তোমাকে ভালবেসে কল্পনায় জীবনের মরুভূমেও যে নন্দনকানন সৃজন করেছিলুম, তুমিই স্বহস্তে যদি তাতে দাবানল জ্বাললে, তাহলে আমার এই শূন্য, উদ্দেশ্য-হীন জীবনে প্রয়োজন কি? আমি সংসার ছাড়ব, দেশে দেশে বনে বনে সন্ন্যাসী-বেশে ভ্রমণ করব, তাতে যদি তোমাকে ভুলতে পারি তো ভুলব, নইলে তোমারই মূর্ত্তি আজীবন ধ্যান করে কাটাব। তুমি অভাগাকে ভুলে যাও, আমার ভাবনা তোমাকে তিলমাত্রও যেন ব্যথা না দেয়। বিদায় তবে বিদায়, আর কখনো এ অভাগাকে দেখতে পাবে না।”

 হিরণের অর্দ্ধেক কথাও কনকের কর্ণে প্রবেশ করিল না, কনক তখন আপনাতে আপনি ছিল না। যখন কনকের চমক ভাঙ্গিল, যখন বালিকা কনকের আজ কথা ফুটিল, যখন সে বলিতে গেল, “হিরণকুমার আমার নিজের কষ্ট আজীবন সইতে পারি, কিন্তু তোমার কষ্ট কি করে সহ্য করব? তোমার কনক তোমার জন্য সমস্ত বিসর্জ্জন দিতে প্রস্তুত।” তখন মস্তক তুলিয়া কনক দেখিল, পার্শ্বে সেই আজন্মপরিচিত পথ ঘাট ও রক্ষাবলী, সম্মুখে সেই অনন্ত-কালপ্রবাহিনী গঙ্গা, কিন্তু হিরণকুমার আর এখানে নাই। কনকের হৃদয় ভাঙ্গিয়া গেল, বোধ হইল তাহার চরণতলে পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত যেন গহ্বর হইয়া গিয়াছে, কনক শূন্য অবলম্বন করিয়া রহিয়াছে। অজস্র অশ্রুধারা কনকের কপোল বাহিয়া পড়িতে লাগিল। হৃদয়ের অভ্যন্তর হইতে মর্ম্মভেদী কষ্টে অশ্রুধারা উথলিয়া উঠিল। কাঁদিতে কাঁদিতে কনক দ্রুতপদে ঘাট হইতে উঠিয়া খানিক দূর আসিল, কিন্তু সে বেশী দূর নহে। মর্ম্মাহত ক্ষুদ্র বালিকা আর কত পারিবে? তীরে একটী গাছতলায় আসিয়া আশ্রয় জন্য একটী শাখা ধরিল, ক্রমে হস্ত পদ শিথিল হইয়া বৃক্ষতলে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল।