পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৬
জননী

নাই। বিবাহ তাহাদের হইয়াছিল চার পাঁচ বছর আগে, এতকাল কে যেন তাহাদের প্রেমের উৎস মুখটিতে ছিপি আঁটিয়া রাখিয়াছিল, এখানে মুক্তি পাইয়া তাহা উথলিয়া উঠিয়াছে। ভাল শ্যামার লাগিত না। নিরানন্দ বিমর্ষ তাহার জীবন, সন্তানের তাহার অন্নবস্ত্রের অভাব, তারই পায়ের তলে তারই বাড়ির একতলায় এ কি বিসদৃশ প্রণয়-রস-রঙ্গ? কই, বয়সকালে শ্যামা তো ওরকম ছিল না? স্বামীর সঙ্গে মেয়েমানুষের এত কি ছেলেমানুষী, হাসাহাসি, খেলা ও ছল করা কলহ? একটি ছেলে হইয়াছে, সম্মুখে অন্ধকার ভবিষ্যত, কত দুশ্চিন্তা কত দায়িত্ব ওদের, এমন হাল্কা ফাজলামিতে দিন কাটাইলে চলিবে কেন?

 বৌটির নাম কনকলতা। শ্যামা জিজ্ঞাসা করিত, তোমার স্বামী কত মাইনে পান?

 কনক বলিত, কত আর পাবে, মাছিমারা কেরাণী তো, বেড়ে বেড়ে নব্বইএর মত হয়েছে,—খরচ চলে না দিদি। একটা ছেলে পড়ালে আরও কিছু আসে, আমি বারণ করি, সারাদিন আপিস করে আবার ছেলে পড়াবে না কচু,—কি হবে বেশি টাকা দিয়ে? যা আসে তাই ঢের,—নয়? মাসের শেষে বড্ড টানাটানি পড়ে দিদি, খরচ চলে না।

 কনক এমনিভাবে কথা বলিত, উল্টাপাল্টা পূব পশ্চিম। বলিত, একা স্বাধীনভাবে সে মহা স্ফূর্তিতে আছে, আবার বলিত একা একা থাকতে ভাল লাগে না দিদি, আত্মীয় স্বজন দু’চারটি কাছে না থাকলে বড্ড যেন ফাঁকাফাঁকা লাগে,—নয়? শ্যামা বুঝিত, আনন্দে আহ্লাদে সোহাগে সে ডগমগ, কথা সে বলে না শুধু বকবক করে, ওর কথার কোন অর্থ নাই। কনকের বয়স বোধ হয় ছিল কুড়ি বাইশ বছর, শ্যামা যে বয়সে প্রথম মা হইয়াছিল,—এই বয়সে বৌটির অবিশ্বাস্য খুকী-ভাবে শ্যামা থ’ বনিয়া যাইত, কেমন রাগ হইত শ্যামার। মেয়েমানুষ এমন নির্ভয়, এমন নিশ্চিন্ত, এমন আহ্লাদী? এই বুদ্ধি-বিবেচনা লইয়া সংসারে ও টিঁকিবে কি করিয়া? বড়লোকের মেয়ে বুঝি এমনি অসার হয়?

 তবু, বিরুদ্ধ সমালোচনা-ভরা শ্যামার মন, কি দিয়া কনক যেন আকর্ষণ করিত। চৌবাচ্চার ধারে ওরা যখন পরস্পরের গায়ে জল ছিটাইয়া