পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২৮
জননী

করিতে করিতে সকলে ফিরিয়া আসে, শঙ্কর আসে বিধান ও চাকরটার গায়ে ভর দিয়া এক পায়ে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে। শামুকে না কিসে শঙ্করের পা কাটিয়া দরদর করিয়া রক্ত পড়িতেছে।

 বকুল দুরন্ত দুঃসাহসী মেয়ে, বকিলে, মারিলে, ব্যথা পাইলে সে কাঁদে না কিন্তু রক্ত দেখিলে সে ভয় পায়, ধূলা-কাদা ধুইয়া শ্যামা যতক্ষণ শঙ্করের পা বাঁধিয়া দেয় সে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিতে থাকে।

 মন্দা ধমক দিয়া বলে, তোর পা কেটেছে নাকি, তুই অত কাঁদছিস কি জন্যে? কেঁদে মেয়ে একেবারে ভাসিয়ে দিলেন!

 শঙ্কর বলে, কেঁদো না বুকু, বেশি কাটেনি তো।

 আগে বিধান হয়ত শঙ্করের জন্য অনায়াসে সাতদিন স্কুল কামাই করিত, এখন পড়াশোনার চেয়ে বড় তাহার কাছে কিছু নাই, সে স্কুলে চলিয়া গেল। কানু ও কালু কোন উপলক্ষে স্কুল কামাই করিতে পারিলে বাঁচে, অতিথির তদ্বিরের জন্য বাড়িতে থাকিতে তারা রাজি ছিল, মন্দার জন্য পারিল না। স্কুলে গেল না শুধু বকুল। সারা দুপুর এক মুহূর্তের জন্য সে শঙ্করের সঙ্গ ছাড়িল না। এ যেন তার বাড়ি-ঘর, শঙ্কর যেন তারই অতিথি, সে ছাড়া আর কে শঙ্করকে আপ্যায়িত করিবে? ফণীকে ঘুম পাড়াইয়া তাহার অবিশ্রাম বকুনি শুনিতে শুনিতে শ্যামার চোখও ঘুমে জড়াইয়া আসে,—বকুলের মুখে যেন ঘুমপাড়ানি গান। বাড়ির কারোর সঙ্গে ও-মেয়েটার স্নেহের আদান-প্রদান নাই, কারো সোহাগ-মমতায় ও ধরা-ছোঁয়া দেয় না, অনুগ্রহের মত করিয়া সুপ্রভার ভালবাসাকে একটু যা গ্রহণ করে, শঙ্করের সঙ্গে এত ওর ভাব হইল কিসে, পরের ছেলে শঙ্কর? এক তার পাগল ছেলে বিধান, আর এক পাগলী মেয়ে বকুল,—মন ওদের বুঝিবার যো নাই। শ্যামা যে এত করে মেয়েটার জন্য, দু’ মিনিট ওর অদ্ভুত অনর্গল বাণী শুনিবার জন্য লুব্ধ হইয়া থাকে, কই শ্যামার সঙ্গে কথা তো বকুল বলে না? কাছে টানিয়া আদর করিতে গেলে মেয়ে ছটফট করে, জননীর দু’টি স্নেহ-ব্যাকুল বাহু যেন ওকে দড়ি দিয়া বাঁধে। জগতে কে কবে এমন মেয়ে দেখিয়াছে?

 শ্যামা একটা হাই তোলে। জিজ্ঞাসা করে, হ্যাঁ শঙ্কর, আমাদের