পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

—আপনি যার জায়গায় এসেছেন তিনি হিস্ট্রি-জিওগ্রাফি-জিওমেট্রিই পড়াতেন।

কলি —'এল-টি।

স্কুলেও পড়েছিলেন। একবার গলা খাকরে নিয়ে—ড্রিল করাতেও পারতেন। চাল বজায় রাখেন ও পড়াবার কাজের থেকে অফিসের কাজই তার বেশি; অনেকটা সময় বসে নিজের কী একটা কম্পোজিশনের বইয়ের প্রাফ দেখেন। নতুন ম্যানুয়াল লেখেন, লম্বা কালো দাড়ি, সোনার চশমা, পরনে শাদা পেন্টালুন, গলাবন্ধ তসরের কোট। বুক পকেট থেকে সোনার চেন ঝুলছে। ইস্কুলের পাচিলের কাছে একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ—সমস্ত ইস্কুলটার ভিতর এই যেন একটু জীবন। আর এই ছেলেরা। কিন্তু মাঠ প্রান্তরের কুয়াশার বিস্তৃতি, কাচপোকানীল কাজলস্নিগ্ধ বট, অসংখ্য ডালপালা গুড়ি জড়িয়ে অজগরের মতো সহস্রধারা লতা, মৃদু বেগুনি ফুল, লাল হিজল, জামের ডালপালার ফঁাকে রাত্রিব তারা, জ্যোৎস্নার চাদ, দিনের অপরিমেয় আকাশের গন্ধ, চট বাবলার জঙ্গল ও বিবির ডাকের ভিতর মানুষ হয়েছিল যারা সেই সব ছেলেদের কথা মনে পড়ে। এদের মুখের দিকে তাকালে তাদের কথা মনে পড়ে কেবল; তারা কত অন্যরকম। দেশের বাড়ির সেই ইস্কুলটা চোখের সামনে জেগে ওঠে; সেই কুড়ি বছর আগের অমূল্য, বিজন অবিনাশ রুক্মিণী— দিনের পর দিন কেটে যায়। মা-র চিঠিতে জানা যায় হেমন্ত কিছুদিন হল দেশে ফিরে এসেছে; এখনো সে সেই মঠেরই সন্ন্যাসী; অনেক জায়গা ঘুরেছে; মাথা মুড়নো—গেরুয়া কাপড় গায়ে, পায়ে একটি কাঠের খড়ম— আহা, হেমন্ত তা হলে দেশে ফিরল আবার ? এই সময়ে দেশে থাকলে বেশ হত। দেশের ইস্কুলেই তারা দুজনে পড়েছিল—হেমন্ত এক ক্লাস উপরে পড়ত; কলেজে উঠেই সে সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যায়। ইস্কুলে থাকতে একটা ঘড়ি দিয়েছিল প্রভাতকে সে; রোজ শেষ রাতে অন্ধকার থাকতে প্রভাত হেমন্তকে ডেকে নিয়ে বেরুত সেই এক ক্রোশ দূরে মধুমুখী দিঘির থেকে পদ্মফুল তুলবার জন্য। পথে একটা শেয়াল একদিন রুখে এসেছিল দুজনকে; সে কী উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় প্রভাতের—পিছনে হেমন্ত ছুটতে-ছুটতে চেচাচ্ছিল, ওরে প্রভাত, থাম-থাম, শোয়ালটা পালিয়ে গেছে—থামবি না রে।’ প্রভাতের মাকে মা বলে ডাকত; কতদিন কত কাজে-আকাজে প্রভাতের কাছে এসেছে সে। কলেজে উঠেই খুব টলস্টয় পড়ত হেমন্ত—টলস্টয়ের উপন্যাস নয়—অন্য বইগুলো। দেখেশুনে প্রভাত এমন ঠাট্টা করত তাকে— ১৩২