পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বই পড়ত সে—কিন্তু নিজে খুব হাসি-তামাশা মজলিশের লোক ছিল—একদিন কলেজে তাকে আর দেখা গেল না—সেই থেকে সন্ন্যাসী— মতো গেল ন্যাড়া হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে। বছর পাঁচেক আগে হেমন্ত যখন দেশে এসেছিল প্রভাত ওকে কমলার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। কমলা প্ৰণাম করল না। কিন্তু হেমন্ত খুব হৃদয়ের প্রসাদে আশীৰ্বাদ করল—একেবারে ঘোমটার ওপর পাঁচটি আঙুল চেপে— তারপর বললে—‘যাক, নাকের ডগা আদি ঘোমটা টানো নি যে এই জন্য তোমাকে ঢের ধন্যবাদ। কমলার ঘোমটা নিঃসংকোচে ধরে টেনে সিঁথির সিন্দুর আদি উঠিয়ে দিল সে— বললে—“তোমরা যে কথা বলবে মেঝে ফেটে যাবে' কথা কমলা বললে না কিছু। কিন্তু বুঝলাম হেমন্ত আবার বাকশক্তি ফিরে পেয়েছে ও শব্দব্রহ্মে তার খুব বিশ্বাস। হেমন্ত—“তোমাদের এই চিৎপটাং কাঠাল কাঠের পিড়ির মতো ভাবগতিক দেখে ইচ্ছে হয় যে কোথাও লুকিয়ে যাই!’ গতবার বলেছিল—‘পাঞ্জাব-মিরাট-পেশোয়ার-অমরনাথ-বন্দ্রনাথের দিকে চললাম রে ভাই। ফিরব কি না শঙ্করী জানেন।’ বাস্তবিক। দেশে ফিরেছে সে এবার ; দেশের চণ্ডীমণ্ডপ, বারোয়ারি তলা, বৈঠকখানা, পথঘাট, মাঠ-প্রান্তর জমিয়ে রাখবে সে কয়েক দিন। দিনের পর দিন কেটে যায়— দু মাস চলে গেল—আরো চার মাস বাকি। মা লিখেছেন : খোকা বেশ গাইতে পারে। কমলা লিখেছে; খোকা পড়াশুনা করে না কিছু, ঘরে থাকে না মোটে, সারাদিন কামারপাড়ায় টইটই করে বেড়ায়। নচ্ছার ছেলেদের সঙ্গে মেশে; রোজই পাড়ার ছেলেদের লাথি কানমলা খেয়ে আসে। ছেলেটার যেন মা-বাবা নেই? সেদিন পায়ে একটা মাদার কাটা ফুটিয়ে আনল— পড়তে-পড়তে চিঠিটা রেখে দেয় প্রভাত— চুরুটটা জুলিয়ে নেয়। এই তো বেশ ; সেই ছমাসের নিঃসহায় শিশু ক্রমেক্রমে মানুষ হয়ে উঠছে। মুহুর্তে মুহুর্তে জীবনের সঙ্গে পরিচয় লাভ করছে। প্রায় পাঁচ বছর আগে যে ছোট্ট টুকটুকে পা দুটো দেখে এসেছিল সে আজ তা (কাটা) ফুটিয়ে নেবার মতো উপযুক্ত হয়ে উঠল। কে জানে ভবিষ্যতের কোনো এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে এই পা হয়তো ট্রেঞ্চের ভিতর ছুটে বেড়াবে— এর পর নিজের জীবন সংগ্রাম প্রভাতের কাছে অনেকটা লঘু বোধ হয়। কিন্তু রাতের বেলা মনের ভেতর কেমন যেন করতে থাকে প্রভাতের; কমলা লিখেছে ছেলেটার যেন মা-বাবা নেই। সারাদিন কত ছেলের তত্ত্বাবধান করে প্রভাত—আর নিজের ছেলেটা পথে-পথে ঘুরে মরে। আরো গভীর রাতে প্রভাতের মনে হল : পাঁচ বছর আগে লাল তুলতুলে ছোট্ট যে দুটাে পা সে দেখে এসেছিল—ছোট্ট দুটাে হাত—দেশে গিয়ে এবার আর সে সব দেখবে না সে। ছেলেকে কথায়-কথায় কোলে তুলে নেওয়ারও একটা অসভ্য ১৩৩