পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আলো দেন তবেই তা ঘুচতে পারে। শাদা গোফ জোড়ায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বাবা বললেন—“কিন্তু এটা মনে কোরো না হেম, যে একে-একে তিন হয়, দুই হয় না, এই ভুল ধারণা নিয়ে তুমি জীবন চালাচ্ছ। হয়তো আমার এ ভগবানে বিশ্বাস, পরলোকে ঐকান্তিক আস্থা, সেই সব ভুল; জীবন-মৃত্যুতে আমিই ধোয়ার ধাধা নিয়ে কাটালাম। বলে শাদা গোফে হাত বুলিয়ে হাসতে লাগলেন আবার। বললেন, যাক দু-তিন বছরের মধ্যেই বুঝতে পারব সব।' চোখ তুলে তাকালাম বাবার দিকে। —ভগবান ও শান্তির দিকেই যাচ্ছি, এই ভেবে মরব। —“কিন্তু এও তো হতে পারে মরে জেগে উঠব না আর।’ খানিকক্ষণ চুপচাপ। বাবা বললেন—‘কলকাতায় গিয়ে পাঁচশ টাকার ইস্কুল মাস্টারি নিও না।’ —‘কেন ?" —‘হেডমাস্টার হয়তো সামান্য বি-এ পাশ, ফাস্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাসে ইংরেজি পড়াচ্ছেন, আর তোমাকে দেওয়া হবে ভূগোল আর অঙ্ক পড়াতে। এ সব অবিচার চোখ বুজে ক্ষমা করে দেবার মতো কোনো প্রয়োজন দেখি না আমি। চুপ করে ছিলাম। —‘হ্যারিসন রোডের মেসে যদি থাকো তা হলে উল্টাডিঙ্গি, ঢাকুরিয়া বা চেতলাফেৎলায় কোনো টিউশন নিতে যেও না।’ —“নেব না ?” —না' —‘কেন ?? —‘এ সম্বন্ধে আমার মতামত খুব ভালো করেই জানো, হয়তো কুড়ি টাকা পচিশ টাকা দেবে তোমাকে, কিংবা আরো কমই দেবে হয়তো, জীবনে টাকার মুখ তুমিও কম দেখেছ, সে ট্রেন ভাড়া দিতে গিয়ে তোমার অন্তঃকরণ খেকিয়ে উঠবে একেবারে। এ বড় দীনতার কথা, মানুষ এতে বড় খাটো হয়, বৃষ্টিবাদলের মধ্যে পায়ে হেঁটে যাবে সেই উল্টাডিঙ্গি, পায়ে হেঁটে ফিরবে আবার; শরীরের দিক দিয়ে এর ভেতর যত না কষ্ট, আত্মার দিক দিয়ে তার চেয়ে ঢের বেশি অপচয়; কেন এ অপচয় করবে তুমি ? একটু চুপ থেকে হেসে—তা না-হলে কী করব ? —তা তুমি জান, আমার সন্তান হয়ে যখন জন্মেছ তখন অনেক বেদনা বইতে হবে তোমাকে, কিন্তু প্ৰাণ যাতে চিমসে হয়ে যায়, ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে, এমন কোনো জিনিশ করো না তুমি; বেদনা ও সঙ্কীর্ণতা এক জিনিশ নয়। যে-কোনো কাজে বা চিন্তায় জীবনের প্রসার নষ্ট হয়, তার থেকে নিজেকে ঘুচিয়ে নিও। বরং বাড়িতেই চলে আসবে আবার; কী আর করবে ? পনেরো টাকার টিউশনের জন্য, টিউশনের টাকার প্রতিটি কানাকড়িও বাচাবার জন্য হ্যারিসন রোড থেকে চেতলায় হেঁটে যাওয়া-আসা জীবনের এত বড় শকুন কোনোদিন সাজতে যেও না তুমি। হাসছিলাম। বাবা বললেন—শকুন; কিন্তু বৃষ্টি-বাদলের মধ্যে দশ টাকা-পনেরো টাকার টিউশনএর জন্য যারা চেতলা-উণ্টোডাঙ্গা পাড়ি দেয় তাদের দলে ভর্তি না হলে কলকাতায় 8VS)