পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ঝরে গেছে, ফুরিয়ে গেছে যা, তাদেরই কতকগুলি কুড়িয়ে বাড়িয়ে জড় করে একখানা মালা গাঁথা—এ হল আমার জীবনস্মৃতি, জীবনকাহিনী। ঝরা হলেও মরা হয়নি সে পাতাগুলি, মানবপ্রাণের সংস্পর্শে চিরপ্রাণবন্ত হয়ে আছে। আমার জীবনের দীর্ঘপথে দিকে দিকে পূর্বে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে প্রভাতে সন্ধ্যায়, সজনে নির্জনে, দুঃখ দহনে, উৎসবে আনন্দে কত ঘটনা ও কত অঘটন ঘটেছে ঝরেছে সরেছে। পর পর যাঁদের সংযোগে মূল্যহীন জীবনের মূল্য, এ জীবনকাহিনীর পর্বে পর্বে তাঁরাই আছেন ফুটে।

 একদিন ভাদ্রমাসে-ললিতা সপ্তমী তিথিতে মহর্ষির আর একটি দৌহিত্রীর আবির্ভাব হল বাড়ির সূতিকাগহে, বাড়ির ভিতরের তেতালায় একটা রোদফাটা কাঠের ঘরে। তার দরুন বিশেষ কোন সাড়া পড়ল না মহলে মহলে। কারো না কারো জন্ম নিত্য ঘটনা এ বিরাট পরিবারে। নৈমিত্তিক আচরণ সকল বাঁধা দস্তুরমত অনুষ্ঠিত হতে থাকল। ব্রাহ্মধর্মের নূতন পদ্ধতিক্রমে “জাতকর্ম” সংস্কার ও উপাসনাদি হল, আবার আটকৌড়েও হল, ঘরে ঘরে বণ্টিত খইমুড়ি বাতাসাসন্দেশ ও আনন্দ নাড়ুতে ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দধ্বনি নতুন শিশুটিকে স্বাগত করলে।

 এদিকে সদ্যোজাত শিশুকে সনাতন সরষে তেলে জবজবে করে রোজ একবার সূতিকাগৃহের বাহিরে আঙ্গিনায় এনে রৌদ্রে রাখা হতে থাকল। যে উদ্দেশ্যে প্রতীচ্যের সৌখীন সাহেবমেমরা বহৎ তরণীযোগে সাতসমুদ্রপারে দেশদেশান্তে উপনীত হয়ে রকমবেরকমের সুগন্ধি মিশ্রতৈলসিক্ত দেহে sunbath বা রৌদ্রস্নান গ্রহণ করেন সেই tanning বা ধূসরত্বকত্ব এই অতীব সহজ পন্থায় ভারতীয় শিশুর অনতিবিলম্বে লাভ হল।

 সেকালের ধনিগহের আর একটি বাঁধা দস্তুর যোড়াসাঁকোয় চলিত ছিল—শিশুরা মাতৃস্তন্যের পরিবর্তে ধাত্রীস্তন্যে পালিত ও পুষ্ট হত। ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র মায়ের কোল-ছাড়া হয়ে তারা এক একটি দুগ্ধদাত্রী দাই ও এক একটি পর্যবেক্ষণকারিণী পরিচারিকার হস্তে ন্যস্ত হত, মায়ের সঙ্গে তাদের আর কোন সম্পর্ক থাকত না। আমারও রইল না।

 বাড়ির বাঁধ্য নিয়মের একটির কিন্তু আমার মায়ের বেলায় ব্যতিক্রম হয়েছিল। তিনি ঘরজামাই-হওয়া স্বামিসহ পিতৃগৃহবাস করেননি। বিবাহের পূর্বে আমার পিতার সর্ত ছিল ঘরজামাই হয়ে শ্বশুরগৃহে থাকবেন না। কৃষ্ণনগরে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করতে যখন যান তখন মাতামহ