পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাঁর দেশসেবার অনুপ্রেরণা মাতৃভক্তি হতে এসেছিল; মাতার কীর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্যে সখি-সমিতিকে কালোপযোগী রূপান্তর দেওয়ার প্রচেষ্টায় বিধবা শিল্পাশ্রমের জন্ম। নিজের বলে যা কিছু তার প্রতি তাঁর যেমন অনুরাগ, সেই নিজের কিছুটার বিরুদ্ধে যে কেউ এতটুকু হাত তুলতে আসছে বলে সন্দেহ হয়েছে, তাঁর তার প্রতি তেমন খরদৃষ্টি, তার বিরুদ্ধতা থেকে নিজেরটিকে বাঁচানর দৃঢ়তা। তাই প্রখরে-মধুরে মিশ্রিত ছিলেন দিদি। যারা তাঁর মাধুর্যের স্পর্শে এসেছে, তারা চিরমুগ্ধ, অন্যেরা চিরক্ষুব্ধ।

 একবার মা যাচ্ছিলেন মেজমামার সঙ্গে কারোয়ারে। কতদিন ধরে তার জন্যে উদ্যোগ-আয়োজন চলছিল। বাড়িতে দর্জি বসে গিয়েছিল, মায়ের জন্যে নতুন নতুন কাপড় সেলাই চলছিল। সঙ্গে সঙ্গে দিদিরও দু-চারখানা হয়ে যাচ্ছিল। মা যাবার দুদিন আগে থেকে দিদির চোখে জল এল। মা তাঁর সঙ্গিনী ছিলেন—তাই মায়ের সঙ্গহীন দিনগুলোর কল্পনায় তাঁর চোখ জলে ভরল। আমার পক্ষে মা এ-বাড়ি থাকুন বা মেজমামার বাড়িতে কারোয়ারে গিয়ে থাকুন—কোন তফাৎই হয় না। তাঁর সঙ্গ আমি কখনো পাইনে—দূরে দূরে ঝি-চাকর, পণ্ডিত-মাস্টার, পড়াশুনার মধ্যেই থাকি। তাই তাঁর বিরহ-সম্ভাবনা আমার মনে কোন ঢেউ তুললে না। দিদি বিয়ের কয়েক বছর পরে নিজের বাড়ি চলে গেলে আমি একা যখন মায়ের কাছে থাকতে লাগলুম—দাদাও যখন বিলেতে, তখন থেকে মায়ের বেশী কাছাকাছি হলুম। সেদিন কিন্তু দিদির কান্নায় ও আমার চোখ শুকনো থাকায় প্রমাণ হয়ে গেল, আমি ভালবাসতে জানিনে। দিদিই খোঁটা দিলেন।

 মার জন্যে সব করতে পারেন বলে সকলের জন্যেই কি পারেন? তা নয়। মা ছাড়া অধিকাংশেরই প্রতি দিদি পরম উদাসীন। কলকাতায় যে বছর জুবেয়ার সাহেবের অনুষ্ঠিত প্রকাণ্ড প্রদর্শনী হয়—মা তাঁর ‘বকুলফুল’কে তাতে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দিদির কাছাকাছি থাকতে বলেন—দিদি ভাল করে সব দেখাতে শুনতে পারবেন বলে। এদিকে সে প্রদর্শনী এত বড়, আর তাতে চিত্তাকর্ষক এত কিছু দ্রষ্টব্য রয়েছে যে, সেসব ফেলে বকুলফুলকে গাধাবোটের মত টেনে বেড়ান তাঁর পক্ষে কতক্ষণ সম্ভব? দিদি আপন মনের বেগে এ-ঘর ও-ঘর এ-আঙ্গিনা ওআঙ্গিনায় ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এদিকে হেঁটে হেঁটে বকুলফুলের পা ব্যথা হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে বেঞ্চে বসে যে বিশ্রাম করে করে যেতে

৬১
৬১