সেই দক্ষিণের বারান্দাতেই, ঠিক তেমনি হুঁকো কলকে ফরসি সাজিয়ে বসি। বাবামশায় যেখানে বসতেন সেখানে দাদা বসে ছবি আঁকেন, একটু তফাতে আমি বসি পুবের বড় খিলেনের ধারে, তার পর বসেন সমরদা। আমাদের বৈঠকেও সেইরকম শালওয়ালা আসে, নতুন নতুন বন্ধুবান্ধব আসে। সামনের বাগানে সেই সব গাছ; দাদামশায়ের হাতে পোঁতা নারকেলগাছ, কাঁঠালগাছ, বাবামশায়ের শখের বাগানে সেই ফোয়ারায় জল ছাড়ে, সেই ভাগবত মালী, সব দেখা যায় বারান্দায় বসে। বিকেলে পাথর-বাঁধানো গোল চাতালে বসি, কাঁচের ফরসিতে সেই গোলাপজলে গোলাপপাপড়ি মিশিয়ে তামাক টানি। কাল বদলেও যেন বদলায়নি, তিন পুরুষের আবহাওয়া খানিক খানিক বইছে তখনো দক্ষিণের বারান্দায়। ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধ হবে, সেই বারান্দায় লম্বা ভোজের টেবিল পড়ল, লম্বা উর্দি পরে সেই নবীন বাবুর্চি, সেই বিশ্বেশ্বর হুঁকোবরদার দেখা দিল, সেই সব পুরানো ঝাড়লণ্ঠনের বাতি জ্বলল, প্লেট গ্লাস সাজানো হল। তিন পুরুষের সেই সব গানের সুর এসে মেশে আবার নতুন নতুন গানের সঙ্গে, রবিকার গানের সঙ্গে, দ্বিজুবাবুর গানের সঙ্গে।
আরো হলে আমলে যখন আমরা আর্টিস্ট হয়ে উঠেছি, আর্ট সোসাইটির মেম্বর হয়েছি, বড় বড় সাহেবসুবো জজ ম্যাজিস্ট্রেট লাট আসেন বাড়িতে—কমলালেবুর শরবত, পানতামাক, বেলফুলে ভরে যায় সেই দক্ষিণের বারান্দা। বারান্দার পাশের বড় স্টুডিয়োতেই বীনকারের বীণা গভীর রাত্রে থেমে যায় সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে। আবার যখন বাড়িতে কারো বিয়ে, লৌকিকতা পাঠাতে হয়, মেয়েরা থালা সাজিয়ে দেয়, সেই সওগাতের থালায় থালায় ভরে যায় সেই লম্বা বারান্দা।
তোমরা ভাবো, ঘরের ভিতরে স্টুডিয়োতে বসে ছবি আঁকতুম, তা নয়। বারান্দার এক দিকে আমি আর-একদিকে ছাত্ররা বসে যেত। মুসলমান ছাত্র আমার শমিউজমা একদিকে আসন পেতে বসে সারাদিন ছবি আঁকে, সন্ধ্যে হলে মক্কামুখো হয়ে নমাজ পড়ে নেয় ওই বারান্দাতেই। অবারিত দ্বার দক্ষিণের বারান্দায়, সবাই আসছে, বসছে, ছবি আঁকছি, গান চলছে, গল্পও হচ্ছে। এমনি করেই ছবি এঁকে অভ্যস্ত আমি। অবিনাশ পাগলা সেও আসে, কত রকম বুজরুকি দেখাতে লোক আনে। একদিন একটা লোক ফুঁ দিয়ে গোলাপের গন্ধ বাড়িময় ছড়িয়ে চলে গেল। বারান্দা যেন একটা জীবন্ত মিউজিয়াম। নানা চরিত্রের মানুষ দেখতে রাস্তায় বেরতে হত না, তার আপনিই উঠে আসত সেখানে।