বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৮
জোড়াসাঁকোর ধারে

লোকেরা বাবামশায়কে চিনত, হোটেলের খানসাম বাবুর্চিরা অবধি। একবার বড়দাদারা অমৃতসর যান, যে হোটেলে বাবামশায় থাকতেন সেই হোটেলেই তাঁরা উঠেছেন। হোটেলের এক বুড়ো বাবুর্চি তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, বাবামশায়ের নাম করে যে সেই বাবু কোথায়? তিনি যখন পশ্চিমে ওই রকম ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন আমরা তখন আর কতটুকুই বা, কিন্তু আমাদের কাছে নিয়মমত চিঠি দিতেন। শুধু চিঠি দেওয়া নয় আমাদের চিঠি লেখা শেখাতেন। কি ভাবে লিখতে হবে, কোথায় কি ভুল হল চিঠি লিখে লিখে সব ঠিক করে দিতেন। চিঠি লেখা দস্তুরমত শিক্ষা করতে হয়েছে আমাদের। বাড়িতে এক পণ্ডিত আসত তার কাছেও আমাদের চিঠি লেখার শিক্ষা হত। বাবামশায় আমাদের আবার লিখতেন কার কি চাই জানাতে। একবার তিনি তখন দিল্লি আগ্রার দিকে। সেই হিন্দুমেলাতে যে দিল্লির মিনিয়েচার দেখেছিলুম সেই ছিল আমার মনে। আমি লিখলুম, আমার জন্য আগ্রা দিল্লির ছবি আনতে। বাবামশায় ফিরে এলেন; দাদারা যে যা চেয়েছিলেন, বোধ হয় ভালো ভালো জিনিসই হবে, সবাই সবার ফরমাশমাফিক জিনিস পেলেন। আমার জন্য বের হল একটা কাগজের তাড়া। আমি ভেবেছিলুম যে, হিন্দুমেলায় দিল্লির মিনিয়েচারের মত কিছু একটা হবে। কাগজের তাড়া খুলে দেখি আগ্রা দিল্লির কতকগুলো পট। সাদা কাগজের উপরে যেমন কালিঘাট লক্ষ্ণৌয়ের পট হয় সেই রকম হাতে লেখা আগ্রা দিল্লির ছবি আঁকা। এখন আর সে সব পট পাওয়াই যায় না। সেগুলি থাকলে আজ খুব দামি জিনিস হত। তখন কি আর করি, তা-ই খুলে খুলে দেখলুম, কয়েকদিন বাদে ছিঁড়ে কুটে কোথায় উড়িয়ে দিলুম। জানি কি তখন সে সব জিনিসের মূল্য!

 বাবামশায় আমার কথা বলতেন, ‘ওকে আর বিদেশে পাঠাব না। ও আমার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ভারতবর্ষ দেখবে, ভারতবর্ষ জানবে। এদেশটাই ওকে দেখাব ভালো করে।’ তাই হল, বাবামশায় মারা গেলেন, আমার আর বিদেশ যাওয়া হল না, এখনও ভারতবর্ষকেই দেখছি, জানছি। বড় হবার পরে যখন ছবি আঁকা নিয়েই মেতে রইলুম, মার মনে বড় ভাবনা হল যে, এই ছেলেটার লেখাপড়াও হল না বিষয়কর্মও শিখল না, কিছুই হল না। তার পর যখন দিল্লির দরবার থেকে সোনার মেডেল এল, আর্টস্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল হলুম, চারদিকে নাম রটতে লাগল, তখন মা বললেন, ‘আমি ভয় পেয়েছিলুম যে কিছুই তোর হল না। এখন মনে হচ্ছে যে কিছু একটা হলি তবুও।’