পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শ্বশ্রুঠকুরানী স্বহস্তে আনিয়া জামাতাকে নিজে খাওয়াইতে বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হৈম কি আসতে চাইলে না।

 নির্মল কহিল, না।

 তারা জানে তুমি কেন আসছ?

 নির্মল মাথা নাড়িয়া বলিল, জানে বৈ কি, সমস্তই জানে।

 তবু মানা করলে না?

 তাঁহার প্রশ্ন ও কণ্ঠস্বরে নির্মল পীড়া অনুভব করিয়া বলিল, মানা কেন করবে মা? সে ত জানে আমি অন্যায় কাজে কোনদিনই হাত দিইনে।

 আর তার বাপই কেবল অন্যায় কাজে হাত দিয়ে বেড়ায়, এই কি সে জানে নির্মল? বলিয়া তিনি ক্ষণকাল নতমুখে স্থির থাকিয়া অকস্মাৎ আবেগের সহিত বলিয়া উঠিলেন, তা সে যাই কেন না জানুক বাছা, এ তুমি করতে পারবে না―এ কাজে তোমাকে আমি কোনমতেই নামতে দিতে পারব না। শ্বশুর-জামাইয়ে লড়াই করবে, গাঁয়ের লোক তামাসা দেখবে, তার আগে আমি জলে ডুব দিয়ে মরব, তোমাকে বলে রাখলাম বাবা।

 নির্মল আস্তে আস্তে বলিল, কিন্তু যে পীড়িত, যে অসহায়, তাকে রক্ষা করাই ত আমাদের ব্যবসা মা।

 শাশুড়ী কহিলেন, কিন্তু ব্যবসাই ত মানষের সমস্ত নয় বাছা। উকিল-ব্যারিস্টারের মা-বোন আছে, স্ত্রী আছে, শ্বশুর-শাশুড়ী আছে―গুরুজনের মান-মর্যাদা রাখার ব্যবস্থা সংসারে তাদের জন্যেও তৈরি হয়েছে।

 নির্মল ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হয়েছে বৈ কি মা, নিশ্চয় হয়েছে। তাহার পরে সমস্ত ব্যাপারটা লঘু করিয়া দিবার অভিপ্রায়ে একটু হাসিয়া বলিল, আর শেষ পর্যন্ত হয়ত লড়াই-ঝগড়া কিছুই না হতে পারে।

 গৃহিণীর মুখ তাহাতে প্রসন্ন হইল না, কহিলেন, পারে, কিন্তু সে শুধু তোমার শ্বশুরের সর্বরকমে হার হলেই পারে। কিন্তু তার পরে আর তাঁর রায়মশাই হয়ে এ গ্রামে বাস করা চলবে না। তাছাড়া ষোড়শী দুর্বলও নয়, অসহায়ও নয়। তার ঠাঙাড়ে ডাকাতের দল আছে, তাকে জমিদার ভয় করে। তার একখানা চিঠির জোরে মানষে পাঁচ শ’ ক্রোশ দূর থেকে ঘরদোর ছেলেপুলে ফেলে চলে আসে, আমরা যা এক শ’ খানা চিঠিতে পারিনে। তারা হলো ভৈরবী, তুকতাক মন্ত্রতন্ত্র কত কি জানে। তা সে থাক ভাল, যাক ভাল, আমার ক্ষতি নেই―তার পাপের ভরা সে-ই বইবে, কিন্তু চোখের ওপর আমার নিজের মেয়ের সর্বনাশ আমি হতে দেব না নির্মল, তা লোকে যাই বলুক আর যাই করুক।

 নির্মল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। যেভাবেই হোক, এদিকে জানাজানি হইতেও কিছু বাকী নাই এবং ষড়যন্ত্রেরও কোন ত্রুটি ঘটে নাই। তাহার শ্বশুর সকল আঁটঘাট বাঁধিয়া রাখিয়াছেন, ছিদ্র বাহির করিবার জো নাই। তাহার চুপচাপ প্রকৃতির শাশড়ীঠাকুরানী যে এমন মজবুত করিয়া কথা কহিতে জানেন, ইহা সে মনে

১১৭