বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ব্যাকুল হতে আপনাকে হতো না। এই বলিয়া ফকির দ্বারসংলগ্ন মূর্তিবৎ স্থির হৈমবতীকে ইঙ্গিতে দেখাইয়া দিলেন।

 হতবুদ্ধি জনার্দন হঠাৎ উত্তর খুঁজিয়া না পাইয়া কহিলেন, ও-সব বাজে কথা।

 ফকির তেমনি হাসিমুখে বলিলেন, পাকা বীজও পাথরের উপর পড়ে বাজে হয়ে যায়, আমার এতটা বয়সে সে আমি জানতুম। আমি কাজের কথাও বলচি। মহাপাপিষ্ঠ জমিদারটিকে কেন যে মা আমার বাঁচাতে গেলেন সে আমিও জানিনে―জিজ্ঞেস করেও জবাব পাইনি। আমার বিশ্বাস, কারণ ছিল―আপনাদের বিশ্বাস সেই হেতুটা মন্দ। এখানে মাতঙ্গিনী ভৈরবীর কথাটা তুলতে পারতুম, কিন্তু একজনের ভাল করবার জন্যেও অন্যের গ্লানি করা আমাদের ধর্মে নিষেধ, তাই আমি সে নজির দেব না। কিন্তু আপনাকে আমার অনেক কথা বলবার আছে রায়মহাশয়। এ যদি কেবল তারাদাসের সঙ্গেই হতো, হয়ত আমি মাঝে পড়তে যেতাম না, কিন্তু আপনারা, বিশেষ করে আপনি নিজে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়েছেন, কিসের জন্য শুনি? ষোড়শীকে ত একা নয়, আরও অনেক মেয়ে আছে। গ্রামের বুকের মধ্যে বসে লোকটা যখন রাত্রির পর রাত্রি মানুষের মান-ইজ্জত অপহরণ করছিল, তখন কোথায় ছিলেন শিরোমণি, কোথায় ছিলেন জনার্দন রায়? সে যখন গরীবের সর্বস্ব শোষণ করে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করে নিয়ে গেল, তার কতখানি বুকের রক্ত আপনি তাদের জমিজমা, বাড়িঘরদ্বার বাঁধা রেখে যুগিয়েছিলেন শুনি? কিন্তু থাক রায়মহাশয়, আপনার মেয়ে-জামাই দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের চোখের সুমুখে আর আপনার মহাপাপের ভরা উন্মুক্ত করে ধরব না।

 এই বলিয়া সেই মুসলমান ফকির নীরব হইলেন, কিন্তু তাঁহার নিদারুণ অভিযোগের শেষ বাক্যটা যেন শেষ হইয়াও নিঃশেষ হইল না। কাহারও মুখে কথা নাই, সমস্ত ঘরটা স্তব্ধ হইয়া রহিল, কেবল একটা তীব্র কণ্ঠের রেশ যেন চারিদিকের প্রাচীর হইতে বারংবার প্রতিহত হইয়া কেবল ধিক্‌ ধিক্‌ করিতে লাগিল।

 হৈম কাহারও প্রতি দৃষ্টিপাত করিল না; নীরবে নতমুখে ধীরে ধীরে অন্যত্র চলিয়া গেল, এবং ব্যারিস্টার-সাহেব সেইখানে তাঁহার চৌকির উপর স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিলেন।

 ফকির ভৈরবীকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, মা, চল আমরা যাই। এই বলিয়া তিনি আর দ্বিতীয় কথা না বলিয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন। প্রাঙ্গণের বাহিরে আসিয়া দেখিলেন সদর দরজার একপাশে দাঁড়াইয়া হৈম। তাহার দুইচক্ষু ছলছল করিতেছে; সে অশ্রু-সজলদৃষ্টি ফকিরের মুখের প্রতি তুলিয়া কহিল, বাবা, আমার স্বামীকে আপনি মাপ করুন।

 ফকির বিস্মিত হইয়া কহিলেন, কেন মা?

 হৈম তাহার উত্তর না দিয়া কহিল, আমার স্বামীকে নিয়ে যদি আপনার আশ্রমে যাই আপনি দেখা করবেন?

 এবার ফকির হাসিলেন; তারপরে স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, করব বৈ কি মা! তোমাদের দুজনের নিমন্ত্রণ রইল, সময় পেলে যেয়ো।

৪৯

 দেঃ পাঃ―৪