সাহেব সেইখানে বিমূঢ়ের মত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। একটা নমস্কার পর্যন্ত করা হইল না―যে ফকিরের জন্য এই, তাঁহার উদ্দেশে একটা নমস্কার পর্যন্ত জানানো হইল না। তাহার পরে নির্দিষ্ট পথ ধরিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইলেন।
দশ
বসুসাহেব যখন শ্বশুরবাটীতে আসিয়া প্রবেশ করিলেন, তখন তাহারই জন্য বাড়িময় একটা উৎকণ্ঠার সাড়া পড়িয়া গেছে। ঘরে এবং বাইরে যেখানে যত আস্ত এবং ভাঙ্গা লণ্ঠন ছিল সংগ্রহ হইয়াছে এবং এই দুর্যোগের রাত্রে এগুলিকে কার্যোপযোগী করিয়া তুলিবার প্রচেষ্টায় বাড়িসদ্ধ সকলে গলদঘর্ম হইয়া উঠিয়াছে। চাকর বাকর ও আত্মীয় অনুগত লইয়া একটা অভিযানের দল তৈরি হইয়াছে এবং রায়মহাশয় নিজে সমস্ত তত্ত্বাবধান করিতেছেন কাহারা কোন্ দিকে যাইবে, কোন্ পথ, কোন্ মাঠ, কোন্ বনজঙ্গল অনুসন্ধান করিবে, বারংবার উপদেশ দিতেছেন। তাঁহার আচরণে ও কণ্ঠস্বর কেবল উদ্বেগ নয়, আতঙ্ক প্রকাশ পাইয়াছে। এখনও প্রকাশ করিয়া কিছু বলেন নাই সত্য, কিন্তু যে ভয়টা তাঁহার মনের মধ্যে উঁকি মারিতেছে তাহা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। তিনি জানিতেন ষোড়শীর কয়েকজন একান্ত অনুগত ভূমিজ ও বাগদী প্রজা আছে। তাহারা যেমন উদ্ধত তেমনি নিষ্ঠুর। ডাকাতি করে বলিয়া পুলিশের খাতায় নাম-ধাম পর্যন্ত লেখা আছে―ইহারা এই অন্ধকার রাত্রে কোথাও একাকী পাইয়া যদি তাহাদের ভৈরবী-মায়ের প্রতি অবিচার স্মরণ করিয়া সহসা প্রতিহিংসায় উত্তেজিত হইয়া উঠে ত সেখানেও বিচারের আশা করা বথা।
হৈম একপাশে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া সমস্তই দেখিতেছিল, পিতার আশঙ্কাও তাহার দৃষ্টি এড়ায় নাই, কিন্তু তখন পর্যন্ত সে ভিতরের আসল কথাটা জানিত না। এইটাই আত্মপ্রকাশ করিল তাহার জননীর কথায়। তিনি হঠাৎ বাহিরে আসিয়া স্বামীকে কঠোর অনুযোগ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, সে জামাই মানুষ, তাকে কেন তোমাদের ঝগড়ার মধ্যস্থ মানা? যার পেছনে ডাকাতের দল রয়েছে, তাকে করবে তোমরা জব্দ? যেখানে পাও আমার নির্মলকে খুঁজে এনে দাও, নইলে যেখানে দু’চক্ষু যায় এই অন্ধকারে আমি বেরিয়ে যাবো। বলিয়া তিনি কাঁদ কাঁদ হইয়া অন্তঃপুরে চলিয়া গেলেন এবং কিছুক্ষণের জন্য কন্যা ও পিতা উভয়েই নির্বাক বিবর্ণমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিলেন।
জনার্দন রায় আত্মসংবরণ করিয়া সান্ত্বনা ও সাহসসূচক কি একটা কথা হৈমকে বলিতে যাইতেছিলেন, ঠিক এমনি সময়ে জামাতা প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গ বাহিয়া জল ঝরিতেছে, জামা-কাপড় জুতা কাদামাখা। শ্বশুরের মুখের কথা
৫৯