পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪
দেবদাস

বলেন, তাইত, পারুকে আর তো রাখা যায় না। তাঁহারা বড়লোক নহেন; তবে ভরসা এই যে, মেয়েটি অতিশয় সুশ্রী। জগতে রূপের যদি মর্যাদা থাকে, তো পার্ব্বতীর জন্য ভাবিতে হইবে না। আরও একটা কথা আছে—সেটা এইখানেই বলিয়া রাখি। চক্রবর্তী-পরিবারে ইতিপূর্বে কন্যার বিবাহে এতটুকু চিন্তা করিতে হইত না, পুত্রের বিবাহে করিতে হইত। কন্যার বিবাহে পণ গ্রহণ করিতেন এবং পুত্রের বিবাহে পণ দিয়া মেয়ে ঘরে আনিতেন। নীলকণ্ঠের পিতাও তাঁহার কন্যার বিবাহে অর্থ গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু নীলকণ্ঠ স্বয়ং এ-প্রথাটাকে ঘৃণা করিতেন। তাঁহার আদৌ ইচ্ছা ছিল না যে, পার্ব্বতীকে বিক্রয় করিয়া অর্থ লাভ করিবেন। পার্ব্বতীর জননী এ-কথা জানিতেন; তাই স্বামীকে কন্যার জন্য তাগাদা করিতেন। ইতিপূর্বে পার্ব্বতীর জননী মনে মনে একটা দুরাশাকে স্থান দিয়াছিলেন—ভাবিয়াছিলেন, দেবদাসের সহিত যদি কোন সূত্রে কন্যার বিবাহ ঘটাইতে পারেন। এ আশা যে নিতান্ত অসম্ভব, তাহা মনে হইত না। ভাবিলেন, দেবদাসকে অনুরোধ করিলে বোধ হয় কোন সুরাহা হইতে পারে। তাই বোধ হয় নীলকণ্ঠের জননী কথায় কথায় দেবদাসের মাতার কাছে কথাটা এইরূপে পাড়িয়াছিলেন—আহা বৌমা, দেবদাসে আর আমার পারুতে কি ভাব! এমনটি কৈ, কোথাও তো দেখা যায় না!

 দেবদাসের জননী বলিলেন, তা আর হবে না খুড়ী, দু'জনে ভাই-বোনের মতোই যে একসঙ্গে মানুষ হয়ে এসেচে।

 হাঁ মা হাঁ—তাইত মনে হয়, যদি দু'জনের—এই দেখ না কেন বৌমা, দেবদাস যখন কলকাতায় গেল, বাছা তখন সবে আট বছরের; সেই বয়সেই ভেবে ভেবে যেন কাঠ হয়ে গেল। দেবদাসের একখানা চিঠি এলে, সেখানা যেন একবারে ওর জপমালা হয়ে উঠত। আমরা সবাই তো তা জানি!

 দেবদাসের জননী মনে মনে সমস্ত বুঝিলেন। একটু হাসিলেন। এ হাসিতে বিদ্রূপ কতটুকু প্রচ্ছন্ন ছিল জানি না, কিন্তু বেদনা অনেকখানি ছিল। তিনিও সব কথা জানিতেন, পার্ব্বতীকে ভালও বাসিতেন। কিন্তু বেচা-কেনা ঘরের মেয়ে যে! তার ওপর আবার ঘরের পাশে কুটুম্ব! ছি ছি! বলিলেন, খুড়ী, কর্তার তো একেবারে ইচ্ছা নয় এই ছেলেবেলায়, বিশেষ পড়াশুনার সময়ে দেবদাসের বিয়ে দেন। তাই তো কর্তা আমাকে এখনও বলেন, বড় ছেলে