আবার রূপ মানে শুধু রূপ নহে, রূপ মানে স্বাস্থ্য। তাহার রূপ যায়, স্বাস্থ্য যায়, যৌবন দু’দিনেই শুকাইয়া ঝরিয়া পড়ে; অতঃপর এই দুর্বল, বিগতযৌবনা রমণীর নিকট হইতে পুরুষ যা-কিছু বলপূর্বক আদায় করিয়া লইতে থাকে; তাহাতে চারিদিকেই অমঙ্গল বাড়িয়া যায়। স্থান ও সময় থাকিলে দেখাইতে পারিতাম, সমাজে নারীর স্থান নামিয়া আসিবার সঙ্গে-সঙ্গেই নর-নারীর উভয়েরই বাঁচিয়া থাকিবার মিয়াদও কেমন করিয়া কমিয়া আসে। এইজন্যই বোধ করি সমস্ত অসভ্য বা অর্ধ-সভ্যেরাই অল্পায়ু। এই প্রসঙ্গে আমরা যদি নিজেদের ঘরের দিকে চোখ ফিরাইয়া দেখি, দেখিতে পাই উহাদের সহিত আমাদের কিছুই মিলে না। উহাদের মত আমাদের রমণীরা অল্পদিনেই স্বাস্থ্য এবং যৌবন হারান না, তাঁহাদের গর্ভের সন্তানও রুগ্ন বা অল্পায়ু হয় না, অল্প বয়সেই বিধবা হইয়া ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দুঃখীর সংসার আরো ভারাক্রান্ত করেন না, এবং প্রয়োজন হইলে তাঁহাদের সৎ ও স্বাধীন জীবিকা অর্জনের পথ-ঘাট আমরা বন্ধ করিয়া দিই নাই, তাহা হইলে নিশ্চয় স্বীকার করিতে হইবে, যে-মূল্য আমরা নারীকে দিয়া আসিতেছি তাহাই ঠিক হইয়াছে। অন্যথা বলিতেই হইবে, আমাদের ভুল হইয়াছে এবং ধর্মতঃ সে ভূল অপনোদন করিতে আমরা বাধ্য। শুধু এই কথাটা একটু সাহস করিয়া দেখিলে অনেক সমস্যার মীমাংসা হইতে পারে যে, যে-সব বিধি-নিষেধের শৃঙ্খল নারী-দেহে পরাইয়া রাখিয়া আমরা নিজেদের সুখ্যাতি নিজেরাই গাহিয়া বেড়াইতেছি, তাহাতে সুফল ফলিতেছে কি না। ভাল-মন্দ দেখিতে পাওয়া শক্ত কাজ নয়, স্বীকার করিতে পারাই শক্ত কাজ। এই শক্ত কাজটাই নির্ভয়ে স্বীকার করিয়া ফেলিতে আমি দেশের পুরুষকে অনুরোধ করি। তাহা হইলেই কি বিধি-নিষেধ থাকিবে, বা থাকিবে না, কোন্টা সময়োপযোগী, এবং তখন কিসে বর্তমানকালে কল্যাণ হইবে, তাহা আপনিই স্থির হইয়া যাইবে। তখন মনুর সময়ে ব্যাতিচারস্রোত প্রবল ছিল, কি ছিল না, এ তর্কের মীমাংসা না হইলেও চলিবে।
পাতা:নারীর মূল্য-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৬৩
অবয়ব
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নারীর মূল্য
৬২