পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ডাক্তার মৃদু হাসিয়া বলিলেন, ও কিছু না। লোকালয়ে আমার পা দুটো কেমন আপনিই খুঁড়িয়ে চলে। গিরিশ মহাপাত্রের চলন মনে পড়ে?

 অপূর্ব্ব থমকাইয়া দাঁড়াইল। কহিল, আপনাকে যেতে হবে না ডাক্তারবাবু।

 ডাক্তার তেমনি মৃদু হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু আপনার মর্য্যাদা?

 অপূর্ব্ব বলিল, আপনার কাছে আবার মর্য্যাদা কি? পায়ের ধুলোর যোগ্যও ত নই। অপনি ছাড়া পৃথিবীতে কি আর কারও এত বড় সাহস আছে!

 এই ডাক্তার ব্যক্তিটির জীবন-ইতিহাসের সহিত অপূর্ব্বর প্রত্যক্ষ পরিচয় কিছুই ছিল না। থাকিলে সে এই অত্যন্ত ক্ষুদ্র ব্যাপার লইয়া এতখানি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিতে লজ্জায় মরিয়া যাইত। সমুদ্রের কাছে গোস্পদের ন্যায় এই পথটুকুতে একাকী হাঁটা এই লোকটির কাছে কি! পুলিশের লোকে যাহাকে সব্যসাচী বলিয়া জানে, দশ-বারোজন দুর্ব্বত্তে মিলিয়া তাহার পথরোধ করিবে কি করিয়া?

 ডাক্তার মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিয়া শেষে ভাল মানুষটির মত কহিলেন, আচ্ছা, তার চেয়ে চলুন না কেন দুইজনেই আবার একসঙ্গে ফিরে যাই। আমাকে একলা যদি বা কেউ আক্রমণ করতে সাহস করে আপনি কাছে থাকলে ত সে সম্ভাবনা থাকবে না।

 অপূর্ব্ব অনিশ্চিতকণ্ঠে বলিল, আবার ফিরে যাব?

 ডাক্তার বলিলেন, দোষ কি? আমার একলা যাবার বিপদের শঙ্কাও থাকবে না।

 থাকব কোথায়?

 আমার কাছে।

 আফিস হইতে ফিরিয়া আজ অপূর্ব্বর খাওয়া হয় নাই, তাহার অত্যন্ত ক্ষুধা বোধ হইতেছিল, একটু লজ্জিত হইয়া কহিল, দেখুন, আমার কিন্তু এখনো খাওয়া হয়নি, আচ্ছা তা না হয় আজ—

 ডাক্তার হাসিমুখে বলিলেন, চলুন না, ভাগ্য পরীক্ষা করে আজ দেখাই যাক। কিন্তু একটা কথা, তেওয়ারী বেচারা বড় চিন্তিত হয়ে থাকবে।

 তেওয়ায়ীর উল্লেখে অপূর্ব্বর মনের মধ্যে হঠাৎ একটা হিংস্র প্রতিশোধের বাসনা প্রবল হইয়া উঠিল, রাগ করিয়া বলিল, মরুকগে ব্যাটা ভেবে,—চলুন যাই। এই বলিয়া সে একরম জোর করিয়াই তাহাকে বাধা দিয়া সেই আলো-আঁধারের জনশূন্য পথে উত্তরে হাঁটিতে হাঁটিতে আবার ফিরিয়া চলিল। এবার কিন্তু ভয়ের কথা তাহার মনে হইল না। পুলিশ থানা পার হইয়া সহসা একসময়ে সে প্রশ্ন করিয়া বসিল, আচ্ছা ভাক্তারবাবু, আপনি কি এ্যানার্কিস্ট?

১০৪