পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাহাকে উদ্দেশ করিয়া ভারতী স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, ভয় নেই তোমার, এরা সেরে উঠবে। কাল সকালেই আমি ডাক্তার, ওষুধ, পথ্য সব পাঠিয়ে দেব—

 তাহার কথা শেষ না হইতেই অপূর্ব্ব পকেটে হাত দিয়া টাকা বাহির করিতেছিল, সেই হাত ভারতী হাত বাড়াইয়া চাপিয়া ধরিয়া নিবারণ করিল। পাঁচকড়ির দৃষ্টি অন্যত্র ছিল, সে ইহা দেখিতে পাইল না, কিন্তু অপূর্ব্বও ইহার হেতু বুঝিল না। ভারতী তখন নিজের জামার পকেট হইতে চার আনা পয়সা বাহির করিয়া তাহার হাতে দিয়া কহিল, ছেলেদের চার পয়সার মিছরি, চার পয়সার সাগু, আর বাকী দুআনার চাল ডাল এনে তুমি এ-বেলার মত খাও পাঁচকড়ি, কাল তোমার ব্যবস্থা করে দেব। আজ আমরা চললাম। এই বলিয়া অপূর্ব্বকে সঙ্গে লইয়া বাহির হইয়া আসিল।

 পথে আসিয়া অপূর্ব্ব ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, আপনি ভারি কৃপণ। আমাকেও দিতে ছিলেন না, নিজেও দিলেন না।

 ভারতী কহিল, দিয়েই ত এলাম।

 একে দিয়ে আসা বলে? তার এই দুঃসময়ে পাই-পয়সার হিসেব করে চার আনা মাত্র হাতে দেওয়া ত শুধু অপমান।

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কত দিতে যাচ্ছিলেন?

 অপূর্ব্ব ঠিক কিছুই করে নাই, খুব সম্ভব হাতে যাহা উঠিত, তাহাই দিত। কিন্তু এখন ভাবিয়া বলিল, অন্ততঃ গোটা-পাঁচেক টাকা।

 ভারতী জিভ কাটিয়া কহিল, ওরে বাপ্‌রে! সর্ব্বনাশ করেছিলেন আর কি। বাপ ত মদ খেয়ে সারারাত বেহুঁস হয়ে পড়ে থাকতো, কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুটো মরে যেতো।

 মদ খেতো?

 খেতো না! হাতে টাকা পেলে মদ খায় না এমন অসাধারণ ব্যক্তি সংসারে কে আছে?

 অপূর্ব্ব ক্ষণকাল অভিভূতের ন্যায় স্তব্ধভাবে থাকিয়া বলিল, আপনার সব কথায় তামাসা। রুগ্ন সন্তানের চিকিৎসার টাকায় বাপ মদ কিনে খাবে, এ কি কখনো সত্যি হতে পারে?

 ভারতী কহিল, সত্যি না হয় ত আপনি যে ঠাকুরের দিব্যি করতে বলবেন,—মা মনসা, ওলা বিবি—হঠাৎ হাসিয়া ফেলিয়াই কিন্তু আপনাকে তৎক্ষণাৎ সংযত করিয়া লইয়া বলিল, নইলে, দাতার হাত চেপে ধরে দুঃখীকে পেতে দেব না, সত্যি বলুন ত আমি কি এতই ছোট?

১৩৬