পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হইয়াই থাকে ত অভিযোগের কি-ই বা আছে! তারতী তেমনি নিঃশব্দেই স্থির হইয়া বসিয়া রহিল, কেবল অন্ধকারে দুই চক্ষু বাহিয়া তাহার অবিরল জল গড়িতে লাগিল।

 অনতিদূরে গাছপালার মধ্যে হইতে সামান্য একটু আলো দেখা গেল। ডাক্তার দেখাইয়া কহিলেন, ঐ আমার বাসা। এই বাঁকটা পেরোলেই তার দোরগোড়ায় গিয়ে উঠবো। খুব ফ্রি ছিলাম, কি একরকম মায়ায় জড়িয়ে গেলাম, ভারতী, তোমার জন্যেই আমার ভাবনা। কোনো একটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়েচ শুধু এইটুকু যদি যাবার আগে দেখে যেতে পারতাম!

 ভারতী অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া ফেলিল, আমি ত ভালই আছি, দাদা।

 ডাক্তারের মুখ দিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস বাহির হইয়া আসিল। এই বস্তুটা এতই অসাধারণ যে, ভারতীর কানে গিয়া তাহা বিঁধিল। কহিলেন, কোথায় ভাল আছ ভাই? আমার লোক এসে বললে তুমি ঘরে নেই। ভাবলাম জেটির কোথাও এক জায়গায় তোমাকে পাবো, পেলাম না বটে, কিন্তু তখনি নিশ্চয় মনে হ’ল এই নদীর ধারে কোথাও-না-কোথাও দেখা তোমার মিলবেই। দুর্ভাগ্য তোমার আনন্দই শুধু চুরি করে পালায়নি, ভারতী, তোমার সাহসটুকু পর্য্যন্ত নষ্ট করে দিয়ে গেছে।

 এ কথার সম্পূর্ণ তাৎপর্য্য বুঝিতে না পারিয়া ভারতী নীরব হইয়া রহিল। ডাক্তার কহিতে লাগিলেন, সেদিন রাত্রে নিশ্চিন্ত মনে আমাকে বিছানা ছেড়ে দিয়ে তুমি নীচে শুলে। হেসে বললে, দাদা, তুমি কি আবার মানুষ যে তোমাকে আমার লজ্জা বা ভয়? তুমি ঘুমোও। কিন্তু আজ আর সে সাহস নেই। বিশেষ নির্ভর করবার লোক অপূর্ব্ব নয়, তবু সে কাছেই ছিল বলে কালও হয়ত এ আশঙ্কা তোমার মনেও হ’তো না। আশ্চর্য্য এই যে তোমার মত মেয়েরও নির্ভর স্বাধীনতাকে তার মত একটা অক্ষম লোকেও না কত সহজেই ভেঙে দিয়ে যেতে পারে!

 ভারতী মৃদুকণ্ঠে কহিল, কিন্তু উপায় কি দাদা?

 ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, উপায় হয়ত নেই। কিন্তু আমি ভাবছি বোন, চরিত্রকে তোমার সন্দেহ করতে আজ কেউ কাছে নেই বলে তোমার নিজের মনটাই যদি অহরহ তোমাকে সন্দেহ করে বেড়ায় তুমি বাঁচবে কি করে? এমন করে ত কারও প্রাণ বাঁচে না ভারতী।

 এমন করিয়া ভারতী আপনাকে আপনি বিশ্লেষণ করিয়া দেখে নাই। তাহার সময় ছিলই বা কই! তাহার শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের অবধি রহিল না, কিন্তু সে নির্ব্বাক হইয়া রহিল।

 ডাক্তার বলিতে লাগিলেন, আমি আর একটি মেয়েকে জানি, সে জাতে রুশ। কিন্তু তার কথা থাক্। কবে তোমাদের আবার দেখা হবে আমি জানিনে, কিন্তু

১৯৮