পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মনে হয় যেন একদিন হবে। বিধাতা করুন, হোক। তোমার ভালবাসার তুলনা নেই, সেখান থেকে অপূর্ব্বকে কেউ সরাতে পারবে না, কিন্তু নিজেকে তার গ্রহণযোগ্য করে রাখবার আজ থেকে এই যে জীবনব্যাপী অতি-সতর্ক সাধনা শুরু হবে, তার প্রতিদিনের অসম্মানের গ্লানি মনুষ্যত্বকে যে তোমার একেবারে খর্ব্ব করে দেখে ভারতী! হায় রে! এমন চিরশুদ্ধ হৃদয়ের মূল্য যেখানে নেই, সেখানে এমনি করে বোঝাতে হয়! পদ্মফুল চিবিয়ে না খেয়ে যারা তৃপ্তি মানে না, দেহের শুদ্ধতা দিয়ে এমনি করেই কান মলে তার কাছে দাম আদায় হয়। হবেও হয়ত। কি জানি, কপালে বাঁচবার মিয়াদ ততদিন আমার আছে কি না, কিন্তু যদি থাকে দিদি, বোন বলে গর্ব্ব করবার তখন সব্যসাচীর আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে তাহলে কি করতে বল? তুমিই ত আমাকে বারংবার বলেচ সংসারের মধ্যে ফিরে যেতে।

 কিন্তু মাথা হেঁট করে যেতে ত বলিনি।

 ভারতী বলিল, কিন্তু মেয়েমানুষের উঁচু মাথা ত সবাই পছন্দ করে না দাদা।

 ডাক্তার বলিলেন, তবে যেয়ো না।

 ভারতী ম্লানমুখে হাসিয়া বলিল, সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো দাদা, যাওয়া আমার হবে না। সমস্ত পথ নিজের হাতে বন্ধ করে কেবল একটি পথ খুলে রেখেছিলাম, সেও আজ বন্ধ হয়ে গেছে এ তো তুমি নিজের চোখেই দেখে এসেচ। এখন, যে পথ আমাকে দেখিয়ে দেবে সেই পথেই চলবো; কেবল এইটুকু মিনতি আমার রেখো, তোমাদের ভয়ঙ্কর পথে আমাকে তুমি ডেকো না। ভগবানের যত দুস্প্রাপ্য বস্তু পাবারও এত রাস্তা বেরিয়েচে, শুধু তোমার লক্ষ্যে পৌঁছিবারই রক্তপাত ছাড়া আর দ্বিতীয় পথ নেই? আমার একান্ত মনের বিশ্বাস মানুষের বুদ্ধি একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, কোথাও-না-কোথাও অন্য পথ আছেই আছে। এখন থেকে তারই সন্ধানে আমি পথে বার হবো। ভয়ানক দুঃখ যে কি সে-রাত্রে আমি টের পেয়েছি, যেদিন তোমরা তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলে।

 ডাক্তার হাসিলেন, কহিলেন, এই আমার বাসা। এই বলিয়া ক্ষুদ্র নৌকা জোর করিয়া ডাঙ্গায় ঠেলিয়া দিয়া অবতরণ করিলেন এবং লণ্ঠন হাতে তুলিয়া লইয়া পথ দেখাইয়া কহিলেন, জুতো খুলে নেমে এসো। পায়ে একটু কাদা লাগবে।

 ভারতী নিঃশব্দে নামিয়া আসিল। গোটা চারেক মোটা মোটা সেগুন কাঠের খুঁটির উপর পুরাতন ও প্রায় অব্যবহার্য তক্তা মারিয়া একটা কাঠের বাড়ি খাড়া করা হইয়াছে। জোয়ারের জল সরিয়া গিয়া সমস্ত তলাটা একহাঁটু পাঁক পড়িয়াছে, লতা-পাতা, গাছ-পালা পচার দুর্গন্ধে বাতাস পর্য্যন্ত ভারী হইয়া উঠিয়াছে, সুমুখের

১৯৯