পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 সুমিত্রা মাথা নাড়িয়া জানাইল, হাঁ।

 ডাক্তার কহিলেন, আমি তখন ছিতায় ভাঙা দল পুনর্গঠনে ব্যস্ত, একটা খবর পর্য্যন্ত পেলাম না যে, আমার একখানা হাত ভেঙে গেল। অথচ তার বিপক্ষে আদালতে বিচারের তামাসা যখন পুরোদমে চলেছিল তখন রক্ষা করা তাকে একবিন্দু কঠিন ছিল না। আমাদের অধিকাংশ লোক তখন ঐখানেই বাস করছিল। শুধু এতবড় দুর্ঘটনা ঘটলো কেন জানো? ফয়জাবাদের মথুরা দুবে তখন অতি তুচ্ছ অবিচার-কুবিচারের পুনঃ পুনঃ অভিযোগে দলের মন একেবারে বিষ করে তুলেছিল। দুরাণীর মৃত্যুতে সবাই যেন পরিত্রাণ পেলে; আমি ফিরে আসার পর ক্যানটনের মিটিঙে যখন সকল ব্যাপার জানা গেল তখন দুরাণীও নেই, মথুরাও টাইফয়েড জ্বরে মরেচে। প্রতিকারের কিছুই আর ছিল না, কিন্তু ভবিষ্যতের ভয়ে সে রাত্রে গুপ্ত সভা অতিশয় কঠিন দুটো আইন পাশ করে। কৃষ্ণ আইয়ার, তুমি ত উপস্থিত ছিলে, তুমিই বল!

 কৃষ্ণ আইয়ারের মুখ শুষ্ক হইয়া উঠিল, কহিল, আপনি কাকে ইঙ্গিত করচেন আমি ত বুঝতে পারচিনে ডাক্তার।

 ডাক্তার লেশমাত্র ইতস্তত না করিয়া বলিলেন, ব্রজেন্দ্রকে। একটা আইনে এই ছিল, আমার আড়ালে আমার কাজের আলোচনা চলবে না,—

 ব্রজেন্দ্র বিদ্রূপের স্বরে প্রশ্ন করিলেন, আলোচনাও চলবে না।

 ডাক্তার উত্তর দিলেন, না, আড়ালে চলবে না। কিন্তু চলে তা জানি। তার কারণ, সেদিনকার ক্যানটনের সভায় উপস্থিত যাঁরা ছিলেন দুরাণীর মৃত্যুতে তাঁরা যতটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন, আমি ততটা হইনি, সুতরাং এ বস্তু চলেও আসচে, আমিও অবহেলা করেই আসচি। কিন্তু দ্বিতীয়টা গুরুতর অপরাধ, ব্রজেন্দ্র।

 ব্রজেন্দ্র তেমনি উপেক্ষাভরে কহিল, সেটা প্রকাশ করে বলুন।

 ডাক্তার কহিলেন, প্রকাশ করেই বলচি। আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টি করা মারাত্মক অপরাধ। দুরাণীর মৃত্যুর পরে এ বিষয়ে সাবধান হওয়া আমার দরকার।

 ব্রজেন্দ্র কঠিন হইয়া উঠিল, বলিল, সাবধান হওয়া দরকার অপরেরও ঠিক এমনি থাকতে পারে। জগতে প্রয়োজন শুধু আপনারই একচেটে নয়। এই বলিয়া সে সকলের দিকে চাহিল, কিন্তু সকলেই মৌন হইয়া রহিল, কেহই তাহার জবাব দিল না।

 ডাক্তার নিজেও অনেকক্ষণ নির্ব্বাক হইয়া রহিলেন, পরে ধীরে ধীরে বলিলেন, এর শাস্তি হচ্ছে চরম দণ্ড! ভেবেছিলাম যাবার পূর্ব্বে আর কিছু করব না, কিন্তু

২২১