পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 সহসা মুখের আবরণ সরাইয়া সুমিত্রা উঠিয়া বসিল, কহিল, নীচেকার দরজা খুলে কে যেন ঢুকলো ভারতী।

 বাতাস এবং বারিপাতের অবিশ্রাম ঝর ঝর শব্দের মাঝখানে আর কিছুই শুনিতে পাওয়া কঠিন। শঙ্কায় সকলেই চকিত হইয়া উঠিল, ভারতী একমুহূর্ত্ত কান খাড়া করিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, না, কেউ নয়। অপূর্ব্ববাবুর চাকরটা শুধু নীচে আছে। কিন্তু পরক্ষণেই সে সিঁড়িতে পরিচিত পদশব্দে আনন্দ কলরোলে চীৎকার করিয়া উঠিল, আরে এ যে দাদা! এক হাজার, দশ হাজার, বিশ হাজার, এক লক্ষ ওয়েলকম্। হাতের ফল এবং বঁটি ফেলিয়া সিঁড়ির মুখে ছুটিয়া গিয়া বলিল, এক ক্রোর, দশ ক্রোর বিশ ক্রোর, হাজার ক্রোর গুড ইভনিং দাদা, শীগ্‌গির এসো!

 সব্যসাচী ঘরে ঢুকিয়া পিঠের প্রকাণ্ড বোঁচকা নামাইতে নামাইতে সহাস্যে কহিলেন, গুডইভ্‌নিং! গুডইভ্‌নিং! গুডইভ্‌নিং।

 ভারতী তাঁহার দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া কহিল, এই দেখ দাদা, তোমার জন্যে খিচুড়ি রাঁধচি। ওভারকোটটা আগে খোলো। ইঃ—জুতোটুতো সব ভিজে গেছে, দাঁড়াও আগে আমি খুলে দি। এই বলিয়া সে আগে কোট খুলিবে, না হেঁট হইয়া বুকের ফিতা খুলিবে ঠিক করিতে পারিল না। চেয়ারের কাছে টানিয়া আনিয়া জোর করিয়া বসাইয়া দিয়া বলিল, আমি জুতো খুলে দি। এই বৃষ্টিতে একটা গাড়ি করে আসতে নেই! হাঁ দাদা, ওবেলা কি খেয়েছিলে? পেট ভরেছিল? ভালো কথা! ঠাকুরমশায়ের হোটেলে আজ মাংস রান্না হয়েছে আমি খবর পেয়েচি, আনবো দাদা ছুটে গিয়ে এক বাটি? সত্যি বল।

 ডাক্তার হাসিমুখে কহিলেন, আরে, এ আমাকে আজ পাগল করে দেবে না কি!

 ভারতী জুতা খুলিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া মাথায় তাঁহার হাত দিয়া বলিল, যা ভেবেচি ঠিক তাই। ঠিক যেন নেয়ে উঠেচ এমনি ভিজে। এই বলিয়া সে আলনা হইতে তাড়াতাড়ি তোয়ালে আনিতে গেল।

 মিনিট-খানেকের মধ্যে ছেলেমানুষের মত এমনি কাজ করিল যে শশী হাসিয়া ফেলিল। বলিল, আপনাকে যেন ভারতী দু-দশ বছর পরে দেখতে পেয়েচেন।

 ডাক্তার কহিলেন, তার চেয়েও বেশি। এই বলিয়া ভারতীর হাত হইতে তোয়ালে টানিয়া লইয়া কহিলেন, তোর আদরের জ্বালায় আমার প্রাণটা গেল।

 প্রাণ গেল? তবে থাকো বসে। এই বলিয়া ভারতী কৃত্রিম অভিমান করে তাহার ফল ছাড়াইতে ফিরিয়া গিয়া বঁটি লইয়া বসিল। তাহার বন্ধু, সখা,

২৮৬